গরল তমসা
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১
জাপানী বোমার ভয়ে গোটা কলিকাতা মনুষ্যশূন্য বলিয়া বোধ হইতেছে, অবশ্য পৌষের শীতটিও মন্দ পড়েনি এবার। কারণ যাহাই হউক না কেন, সদাচঞ্চল হ্যারিসন রোডে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ কদাচিৎ পাওয়া যাইতেছে। শহরের আওয়াজ বিনা, প্রভাতী চা এবং জলখাবারের সময়টিকে এই শেষ কিছুদিন যাবৎ অপরিচিত ঠেকিতেছে।
ব্যোমকেশ এ নিয়ে আদৌ মাথা ভার করিতেছে কিনা তা বোঝা দায়। অন্য যে কোনও দিনের মতনই আজও সে খবরের কাগজখানার প্রথম প্রান্ত থেকে শেষ প্রান্তে, এবং পুনরায় শেষ থেকে প্রথমে যাতায়াত করিতেছে। বলিলাম, “হিরোহিতোর ভয়ে তোমার মক্কেলরা এখন কতদিন অজ্ঞাতবাসে থাকেন দেখো।”
সমস্ত বিজ্ঞাপনেই বোধ হয় চোখ বোলানো শেষ হইয়াছিল, ব্যোমকেশ কাগজটি গুছিয়া রাখিতে রাখিতে বলিল, “কিছু কিছু নয় বাবা, কিছু কিছু নয়।”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “সে আবার কী!”
“আশ্চর্য, এ লেখা আগে পড়োনি নাকি?
দুনিয়ার মাঝে বাবা কিছু কিছু নয়, কিছু কিছু নয়।
নয়ন মুদিলে সব অন্ধকারময়, বাবা অন্ধকারময়।।
ধন বল জল বল, সহায় সম্পদ বল,
পদ্মদলগত জল, চিহ্ন নাহি রয়।”
এ লেখা সত্যই পড়িনি, কার লেখা সে কথা জিজ্ঞাসা করিতে ব্যোমকেশ মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিল। আমি তাগাদা দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। আমাকে উদগ্রীব হতে দেখে ব্যোমকেশ বলিল, “চিন্তা নেই। অত ভারী পায়ের আওয়াজ মক্কেলের নয়, পুলিশেরই হয়।”
ডিডাকশনটি সঠিক, মিনিটখানেকের মধ্যে আমাদের পূর্বপরিচিত বীরেনবাবু ঘরে প্রবেশ করিলেন। ভদ্রলোক হাস্যমুখর এমন অপবাদ কেউ দেবে না, কিন্তু আজকে তাঁর ভ্রূযুগল যে পরিমাণ কুঞ্চিত হইয়া আছে, তাহাতে স্বাভাবিক আদর আপ্যায়ন করাও উচিত বোধ হইল না। চেয়ারে বসিতে বসিতে বললেন, “কমিশনার সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, সে খবর দিতেই আসা।”
ব্যোমকেশ একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরাইয়া বীরেনবাবুর দিকে প্যাকেটটি এগিয়ে দিল। তিনি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিতে করিতে বলিলেম, “আমি সাহেবকে বলেছিলাম ব্যোমকেশবাবুর কাছে এখনই যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সে কথা তিনি শুনলে তো! তারপর আজ সকালে যা ঘটেছে…” বলিতে বলিতে বীরেনবাবুর খেয়াল হইল তাঁর শ্রোতৃবৃন্দ ভূমিকাটুকু সম্বন্ধেও অবহিত নন। আমাদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “এ ঘটনা আপনাদের জানার কথা নয়, কারণ শুরুতে খবরওয়ালারাও টের পায়নি। আর যখন তারা টের পেয়েছে, তখন পুলিশ নিজে তাদের অনুরোধ করেছে খবর না ছাপাতে। যদিও তারা বোধ হয় সে অনুরোধ আর রাখবে না।”
ব্যোমকেশ ঠোঁট থেকে সিগারেটটা সরাইয়া বলিয়া উঠিল, “বলেন কী! পুলিশকে হাতজোড় করতে হচ্ছে খবরের কাগজের কাছে? অবস্থা তাহলে নিতান্তই বেগতিক।”
হাতজোড় করিবার প্রসঙ্গটি সম্ভবত বীরেনবাবুর মনঃপূত হইল না। একটি অব্যক্ত শব্দ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কারণ আছে। পুরো ঘটনা না শুনলে বুঝতে পারবেন না।”
“তিন সপ্তাহ আগে রামবাগান অঞ্চলে গলির গলি তস্য গলির মধ্যে একটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। অন্য সময়ে মৃতদেহটি নিয়ে আদপেই কোনও হট্টগোল হওয়ার কথা ছিল না। পেশাগত কারণে ও অঞ্চলটিতে মাঝেসাঝেই এ ধরনের অপরাধ ঘটে থাকে।”
ব্যোমকেশ বীরেনবাবুকে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, “অর্থাৎ খুন যিনি হয়েছেন, তাঁর পেশাটি ছিল আদিমতম?”
বীরেনবাবু মাথা নাড়িলেন।
“ঠিকই বুঝেছেন, রামবাগান বলে কথা। তা যা বলছিলাম, এবারে কিন্তু এই খুন নিয়ে কিছু হইচই হল, যদিও শেষরাতের ওই লাশ পুলিশ আসার আগে জনাদুয়েক মানুষই দেখেছিল। কিন্তু অপরাধের নৃশংসতা তাদের এতই বিহ্বল করে তুলল যে, চেনাশোনাদের ঘটনাটার ব্যাপারে না বলে পারল না।” কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, “নৃশংসতার ধরনটা জানা যায়?”
“সে কথাতেই আসছিলাম। পুলিশের কাজ তো আর আজকে শুরু করিনি, কিন্তু এ ধাঁচের হত্যাকাণ্ড আমার চাকুরিজীবনে দেখিওনি, শুনিওনি। হতভাগিনীর গলা কেটে খুন করা হয়েছে, কিন্তু সেটি নৃশংসতার শুরু মাত্র।
“খুন করার পর মহিলার শরীরটিকে হত্যাকারী উন্মুক্ত করে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি বার করে নিয়েছে।”
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। ব্যোমকেশ মুখে বিশেষ রেখাপাত হইল না, দেখিলাম সে নিমগ্ন চিত্তে বীরেনবাবুর কথাই শুনিতেছে।
“সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলিতে চলিতেই গত সপ্তাহে আরেকটি খুন হয়। একই মহল্লা, এবারেও শিকার আরেক দেহোপজীবিনী। এবং…”
“এনারও শরীরটিকে তছনছ করে গেছে?”
বীরেনবাবু মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, “কিন্তু আজ সকালে বোধ হয় দ্বিতীয় খুনের রহস্যোদঘাটনের জন্য সে চত্বরে যাননি?”
বীরেনবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, “ঠিকই ধরেছেন, আজ সকালেই তৃতীয় একটি লাশ পাওয়া গেছে। অবিকল একই পদ্ধতি। রামবাগানে এখন বিকালের পর থেকে আর লোকজন বেরোচ্ছে না। এদিকে কাগজওলারা আর এ খবর চেপে রাখবে না বলেই আমার ধারণা, হয়তো কাল সকালেই দেখতে পাবেন।”
ব্যোমকেশ অন্যমনে বলিল, “জাপানী বোমার ভয়ে রাস্তাঘাট এমনিই ফাঁকা, খুনী তারই ফায়দা তুলছে। তার ওপর এয়ার রেডের আশঙ্কায় রাস্তায় সামান্য আলোটুকুও থাকছে না।”
“খুবই সম্ভব। যাই হোক, আমাকে এখনই লালবাজারে ফিরতে হবে। আজকালের মধ্যে একবার কর্তার সঙ্গে দেখা করে আসবেন। বুঝতেই পারছেন, আর্জেন্ট তলব পাঠিয়েছেন।”
বীরেনবাবু বিদায় নেওয়ার পর ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী মনে হচ্ছে ব্যোমকেশ? এমনতর নৃশংসতা যে কল্পনা করাও মুশকিল।”
ব্যোমকেশ আরামকেদারায় হেলান দিয়া বলিল, “মনুষ্যচরিত্র অজিত, আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দিয়ে তার তল খুঁজে পাবে এ আশা করোই বা কেন? হাজারখানা মোডাস অপারেন্ডি থাকতে পারে। ষড়রিপুর যে কোনওটিই প্রবলতর হয়ে উঠতে পারে।”
“বলো কী! কাম–ক্রোধ–মোহ নয় তাও বোঝা গেল। কিন্তু বাকিগুলো?”
“সেও ভাবলে ঠিকই পেয়ে যাবে। হতেই তো পারে অপরাধী তার এই আপাতব্যাখ্যাহীন নৃশংসতার মধ্য দিয়েই একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, হেঁয়ালির ছন্দটা কেউ মেলাতে পারে কিনা সেটাই দেখতে চায়। এ-ও তো এক ধরনের মদমত্ততাই। এবার যদি মাৎসর্যের কথা ধরো…”
ব্যোমকেশ আরও কিছু বলিতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে পুঁটিরাম ঘরে প্রবেশ করিল, “বাবু, তার।”
টেলিগ্রামটি পড়িতে পড়িতে ব্যোমকেশের চোখে যেন একপলকের জন্য ঝিলিক খেলিয়া গেল। পড়া হইয়া যাওয়ার পর টেলিগ্রামটি সামনের জলচৌকিতে রাখিয়া বলিল, “নাও, একদিনে দু-দুখানা রহস্য। এই না হা মক্কেল, যো মক্কেল করে কাঁদছিলে?”
টেলিগ্রামটি তুলিয়া দেখি জনৈক সুবিমল সান্যাল ব্যোমকেশের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিয়াছেন। জানাইয়াছেন আজ শেষ-অপরাহ্ণে দেখা করিতে চান।
ব্যোমকেশ বলিল, “ভাবছি এখনই একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি। যদি তদন্তের ভার নিতেই হয়, তাহলে বীরেনবাবুর থেকে সহযোগিতা যে নিতান্তই কাম্য, সেটা সাহেবকে একবার মনে করানো দরকার।”
বলিলাম, “রামবাগানেও যাবে নাকি?”
ব্যোমকেশ বিমনা স্বরে বলিল, “হয়তো, হয়তো নয়। লালবাজার থেকে কী খবরাখবর পাওয়া যায়, তার ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।”
আমি আর বাক্যব্যয় না করিয়া লেখার খাতাটি টানিয়া লইলাম। অবস্থাগতিক যা দেখিতেছি, মাসাধিককাল হয়তো রাত্রে লেখালেখি করাই যাইবে না।
২
ব্যোমকেশের ফিরিতে ফিরিতে দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী বুঝলে? কূলকিনারা সম্ভব?”
ব্যোমকেশ গায়ের শালটি আলনায় রাখিতে রাখিতে বলল, “লালবাজারের কারোরই মনে হয় না কূলে ওঠার বিশেষ ইচ্ছা আছে। গতিক যা দেখছি, হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতিটি এত নৃশংস না হলে পুলিশ ভুলেও মাথা ঘামাত না।”
আমাকে বিস্মিত হতে দেখিয়া ব্যোমকেশ ততোধিক বিস্মিত হইল, “যুদ্ধের বাজার, তায় খুন হয়েছে রামবাগানের বারবধূ । তোমার আক্কেলকেও বলিহারি।”
হতাশ হইয়া বলিলাম, “তাহলে সারা সকালের খাটুনি নেহাতই পণ্ডশ্রম?”
ব্যোমকেশ একটা হাই তুলিয়া বলিল, “তা বলতে পারো। লালবাজার যা যা পণ্ড করে বসে আছেন, তাকে ঢেলে সাজাতে যথেষ্টই শ্রম দিতে হয়েছে আজকে। ভাবতে পারো তিনজনের একজনেরও নামধাম জানে না পুলিস? মানে রামবাগানের কোন কোঠায় তারা থাকত সেটুকু জানে, কিন্তু কবে তারা সেখানে এসেছে, কোথা থেকে এসেছে সেসব নিয়ে বিন্দুবিসর্গ ধারণা নেই কারোর।
“মর্গে গিয়ে দেখি বীরেনবাবুর পর্যবেক্ষণও পুরোপুরি ঠিক নয়। ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোই যে শুধু বার করেছে তা নয়, বীভৎসতার চিহ্ন রয়ে গেছে চামড়ার ওপরেও। যেমন ধরো তৃতীয় ভিকটিমের অনামিকাটিও পাওয়া যাচ্ছে না, মৃতদেহ দেখে বুঝলাম সেটিও কেটেই নিয়ে গেছে।”
বিবমিষা বোধ হইল। বলিলাম, “কলকাতায় এই ঘোরতর উন্মাদটি কোথা থেকে এল ব্যোমকেশ? এরকম নরাধমও মানুষ হয়?”
ব্যোমকেশ কিছু বলিল না, শুধু দেখিলাম তার ললাটরেখায় কুঞ্চনের আভাস। এ সময়ে দরজার কড়া নড়িয়া উঠিল। মিনিট দুয়েক পরে পুঁটিরামের পিছন পিছন দোহারা গড়নের এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকিলেন, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, হাতে একটি পোর্টম্যান্টো। প্রথম দর্শনে ছাপোষা বাঙালিই বোধ হয়, যদিও পাঞ্জাবিতে লাগানো একাধিক সোনার বোতাম সাক্ষ্য দিতেছে যে, এনার বিত্তটি নেহাত মধ্যমানের নয়। গৌরবর্ণ, বয়স মনে হয় ষাটের কম হইবে না।
পরিচয়পর্বের পর সুবিমল সান্যাল বলিলেন, “আশা করি আমার তার পেয়েছিলেন। ব্যোমকেশবাবুর অনুমতি ব্যতিরেকেই চলে এসেছি বলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু এমন বিপদে পড়েছি যে, অনুমতির জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। আপনার খবর আমাকে দিয়েছেন আপনার বন্ধু, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত।”
ব্যোমকেশ একটা চেয়ার আগাইয়া দিয়া বলিল, “বসুন। একটু জিরিয়ে নিন, তারপর আপনার বিপদের কথা বিশদে শোনা যাবে।”
“জিরোনোর সময় যদি থাকত ব্যোমকেশবাবু! প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছে অমিয়কে বুঝি আর দেখতে পাব না। মনকে প্রবোধ দেওয়ার শক্তিটুকুও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।”
“অমিয় কে হয় আপনার?”
“অমিয় আমার ছেলে ব্যোমকেশবাবু, একমাত্র ছেলে। আজ এক সপ্তাহ হল সে নিরুদ্দেশ। নিরুদ্দেশ বলছি বটে, আসলে তাকে কেউ বা কারা অপহরণ করেছে।”
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, “অপহরণ করেছে বুঝলেন কী করে? আপনি কি অনুমান করছেন?”
“অনুমান নয় ব্যোমকেশবাবু, এই দেখুন।” সুবিমলবাবু পোর্টম্যান্টো হইতে একটি লেফাফা বার করিয়া ব্যোমকেশকে দিলেন।
ব্যোমকেশ লেফাফার ভেতরের কাগজটি আলোর সম্মুখে ধরায় অদ্ভুত ধাঁচের ট্যারাবেঁকা কিছু অক্ষরে কতকগুলি শব্দ ফুটিয়া উঠিল — ‘তিনদিনের মধ্যে তিরিশ হাজার টাকার বন্দোবস্ত করার জন্য প্রস্তুত হও, নইলে ইহজীবনে ছেলের মুখ আর দেখবে না।’
ব্যোমকেশ বলিল, “এতে তো কোনও ঠিকানা নেই দেখছি। টাকা কি আদৌ পাঠিয়েছিলেন?”
“অবশ্যই। ওরা আরেকটি চিঠিতে জানিয়েছিল, লোহাপট্টির ভেতরের এক গলিতে টাকাটা নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার সময় অপেক্ষা করতে হবে। আমার বিশ্বস্ত কাজের লোক মন্মথই নিয়ে গেছিল সে টাকা।”
ব্যোমকেশ শান্ত চক্ষে সুবিমলবাবুকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কি কোনও জ্ঞাত শত্রু আছে?”
সুবিমল সান্যাল কয়েক মিনিটের জন্য নীরব থাকিয়া বলিলেন, “ব্যোমকেশবাবু, আমি ব্যবসায়ী, ঈশ্বরের দয়ায় আজ বেশ কিছু বছর ধরেই সে ব্যবসা ভালো চলছে। তাতে কার কার চোখ টাটিয়েছে সে কথা তো বলতে পারি না, তবে আমার জানা এমন কোনও লোক নেই, যে এরকম ঘৃণ্য কাজ করতে পারে।”
“কীসের ব্যবসা আপনার?”
“কাঠের। আমি কিন্তু গরিব ঘরের ছেলে, অনেক কষ্ট করে এ জায়গায় পৌঁছেছি। আমার ভাগ্য খোলে বার্মায় কাঠের ঠিকাদারি করতে গিয়ে।”
“বার্মা?” ব্যোমকেশ চকিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “সে দেশে কত বছর ছিলেন?”
“তা বছর দশেক তো হবেই। সে দেশ আমাকে দিয়েছে অনেক কিছুই, আবার ছিনিয়েও নিয়েছে বইকি। আমার স্ত্রীকে রেঙ্গুনেই দাহ করে এসেছি। সে ছিল আমার ভাগ্যলক্ষ্মী, তার মৃত্যুর পরেই ঠিক করলাম আর নয়, এবার কলকাতায় ফিরতে হবে।” বলিতে বলিতে সুবিমল সান্যালের গলাটি ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।
ঘরের পরিবেশটি ভারী হইয়া উঠিয়াছিল, ব্যোমকেশই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিল, “কী হয়েছিল আপনার স্ত্রীর?”
“প্লেগ ব্যোমকেশবাবু, সে মহামারীতে তখন রেঙ্গুনসহ সারা বার্মাতেই কাতারে কাতারে লোক মারা যাচ্ছিল। সর্বনাশী আমার পরিবারকেও ছাড়ল না। অমিয় তখন কলকাতায় কলেজে পড়ছে, প্লেগের জন্যই তাকে তখন রেঙ্গুনে আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম। মাকে শেষবারের জন্য দেখতেও পায়নি সে।”
অমিয়র প্রসঙ্গ উঠিতেই সুবিমলের চৈতন্য ফিরিল। ব্যোমকেশের হাত দুটি ধরিয়া বলিলেন, “টাকা দেওয়ার পর আরও চারদিন কেটে গেছে ব্যোমকেশবাবু, অমিয়র এখনও কোনও খোঁজ নেই। তার মধ্যে আজ আবার চিঠি এসেছে। এবারে দাবি আরও তিরিশ হাজার টাকার। তিনদিনের মধ্যে জোগাড় করে দিতে হবে।”
ব্যোমকেশ ঈষৎ অবাক হইল, “বলেন কী, এক সপ্তাহের মধ্যে আবার তিরিশ হাজার টাকার দাবি? পুলিসে খবর বোধ হয় দিয়ে উঠতে পারেননি?”
সুবিমল সান্যাল মাথা নাড়িলেন, “বুঝতেই তো পারছেন। মা মরা একমাত্র ছেলে, তার সামান্যতম ক্ষতিটুকুও যাতে না হয়, সে কথা আমাকে অনবরত ভাবতে হচ্ছে। পুলিসে খবর দিলে যদি হিতে বিপরীত হয়। সে জন্যই তো আপনার কাছে ছুটে আসা।”
ব্যোমকেশ বলিল, “অমিয়র বন্ধু কেউ আছে? তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা আর কেউ জানে?”
সুবিমলবাবু একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আমি আর মন্মথ ছাড়া নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর আর কেউ জানে না বলেই ধারণা। অমিয় ইদানীং আমার অফিসে বসত, ব্যবসার কাজের দেখাশোনা করত। সেরকম ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধু আছে বলে তো জানি না, তবে সন্ধ্যার দিকে মাঝেমাঝে চৌরঙ্গী এলাকার একটি ক্লাবে যেত।”
“অমিয়র কত বয়স এখন?”
“পঁচিশ। আপনার জন্য ওর একটি ছবিও এনেছি, এই যে।”
ছবিটি এক ঝলক দেখে বোধ হইল অমিয়র মুখমণ্ডলটিতে সামান্য বিষণ্ণতার ইঙ্গিত। উজ্জ্বল এক তরুণ, কিন্তু তার অন্তরে কোথাও যেন একটি চাপা বেদনা থাকিয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ ছবিটি পকেটস্থ করিতে করিতে বলিল, “আপনার বাড়ি একবার যাওয়া দরকার সুবিমলবাবু। কাল সকালে একবার ঘুরে আসা যেতে পারে? আর হ্যাঁ, ওই চিঠিটাও দিয়ে যান।”
“অতি অবশ্য,” ভদ্রলোক হাঁফ ছাড়িয়া বলিলেন, “আমি পারলে এখনই আপনাদের নিয়ে যেতাম। কিন্তু একটু পরেই রাস্তাঘাটের আলো নিভে যাবে, গিয়ে কোনও সুবিধাও হবে না। অমিয়কে খুঁজে পাওয়ার দায়িত্বটি আপনাকে দিতে পেরে কী যে নিশ্চিন্ত বোধ করছি কী বলব।”
সুবিমল সান্যাল প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশকে বলিলাম, “যুদ্ধের বাজারে শহর তো অপরাধের আখড়া হয়ে উঠল দেখছি।”
সারাদিনের শ্রান্তি ব্যোমকেশকে গ্রাস করিয়াছিল। চোখ বুজিয়া বলিল, “তাতে যে আমাদের খুব কিছু সুবিধে হল, এমন কথা মোটেও ভেবো না।”
বলিলাম, “তার অর্থ?”
“অর্থ এই যে, সব অপরাধেরই সুরাহা হতে হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি।”
৩
পরেরদিন সাতসকালে বাঁটুল সর্দার আসিয়া উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া প্রসন্ন বোধ না করিলেও বুঝিলাম ব্যোমকেশের কার্যসূত্রেই তার আগমন। বাঁটুলের গুন্ডামি আমাদের পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকিলেও উত্তর ও মধ্য কলিকাতার অপরাধ জগতের ঠিকুজি কুলুজি তার নখদর্পণে। ব্যোমকেশ তাহাকে যথারীতি সিগারেট ও চা সহকারে আপ্যায়ন করিল। সিগারেটের ঘ্রাণে দেখিলাম বাঁটুলের ধূর্ত মুখটিতে বিশেষ সন্তোষের উদয় হইল, পরে চায়ের পেয়ালাটি তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশকে বলিল, “আপনার কথামতন কালকে ও চত্বরে গেছিলাম কর্তা।”
ব্যোমকেশ বাঁটুলের চোখে চোখ রাখিয়া বলিল, “কী খবর পেলে?”
“খবর পাওয়া কি সোজা কথা, সবাই মুখে কুলুপটি আটকে বসে আছে। তার ওপর রামবাগানের দিকে বহুকাল যাওয়া হয়নি, এবারে গিয়ে দেখি কত যে নতুন মুখ। প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। গ্যাঁটের কড়ি কিছু ফেলতে হল, খবরও মিলেছে কিছু।
“প্রথমজনের নাম কুন্তী, রামবাগানে এসেছিল বছর পাঁচেক আগে, মাঝ তিরিশেক বয়স। দ্বিতীয়জনের নাম রমলা, সে রামবাগানেরই মেয়ে। তার মা-ও ওখানেই থাকত, যদিও সে গত হয়েছে প্রায় বছরখানেক হল। রমলার বয়স তুলনায় কম, বছর কুড়িও নয়। আর তৃতীয় শ্যামা, বছর দুইও হয়নি ও চত্বরে, চল্লিশের ওপরে বয়স।”
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, “কুন্তী আর শ্যামা এর আগে কোথায় থাকত সে, নিয়ে কিছু খবর পেলে?”
বাঁটুল সিগারেটে একটি সুখটান দিয়া বলিল, “কুন্তীর ব্যাপারে কোনও খবর পাওয়া যায়নি, শ্যামা এসেছিল সিলেট থেকে।”
“আর কিছু?”
বাঁটুলের বর্তুলাকার চক্ষুদ্বয় কুঞ্চিত হইল, ব্যোমকেশের দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, “ওই টাকায় আর কত খবর হয় কর্তা? মাগ্যিগন্ডার বাজার, বোঝেনই তো।”
ব্যোমকেশ সম্ভবত একথা শোনার জন্য প্রস্তুতই ছিল। শান্ত স্বরে বলিল, “টাকা পাবে। কিন্তু শর্ত আছে।”
বাঁটুল থমকাইয়া বলিল, “শর্তও আছে? আমি তো ভাবছিলাম আপনারই আমাকে দরকার।”
“দরকার তো বটেই, তাই জন্যই আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে একবার ও তল্লাটে যেতে চাই।”
বাঁটুলের মুখে একটি বিচিত্র হাসি ফুটিয়া উঠিল। সামান্য ব্যঙ্গের স্বরেই বলিল, “আপনারা ভদ্রলোক, ও তল্লাটে গেলে কি ভালো দেখায়?”
দেখিলাম ব্যোমকেশের মুখের একটি মাংসপেশিও নড়িল না, সামান্য কঠিন স্বরে বলিল, “বদনাম রটলে তোমাকে সালিশির জন্য ডাকব না বাঁটুল। আজকে সন্ধ্যাবেলাই যাওয়া চাই।”
ব্যোমকেশের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বাঁটুল অপ্রস্তুত হইয়াছিল, সন্ধ্যাবেলায় হাজিরা দিবে স্বীকার করিয়া বিদায় লইল। আমি মুখ খুলিবার আগেই ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, “তোমার মুখের চেহারাটা দেখার মতন হয়েছিল অজিত। বাঁটুল যে তোমার ঠিক প্রীতির পাত্র নয় তা জানি বটে, তবে আজ তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল পারলে দু ঘা কষিয়ে দাও।”
“ট্যারাব্যাঁকা কথাগুলো শুনলে না? আমার তো গা জ্বলে গেল রীতিমতন।”
ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতেই বলিল, “ট্যারাব্যাঁকা নয় হে, ও ওর মতন করে সোজাসুজি কথাই বলেছে। তোমার মার্জিত রুচির সঙ্গে সে কথা খাপ খায় না বটে, কী আর করা।”
আমি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলাম, “ক্লাস ডিফারেন্সকে আর অস্বীকার করি কি করে বলো?”
ব্যোমকেশ তড়াক করিয়া উঠিয়া আলমারি থেকে একটি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি বাহির করিল, “ক্লাস ডিফারেন্সের কথা মনে করিয়ে ভালো করলে।”
আমার বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টি দেখিয়া বলিল, “সুবিমল সান্যাল এককালে গরিব ছিলেন বলে এখনও ওনাকে সমতুল্য মনে করছ নাকি?”
গতদিনই সুবিমল সান্যালের সাজসজ্জা দেখিয়া একটা আঁচ পাইয়াছিলাম। কিন্তু আজ বিডন স্ট্রিটের মোড়ে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িটি দেখিয়া হতবাক হইয়া গেলাম। ব্যোমকেশ দরোয়ানকে দিয়া এত্তেলা পাঠাইতেছিল, দরোয়ান যাওয়ার পর বলিলাম, “এ বাড়ির ছেলেকে ধরবে না তো কাকে ধরবে বলো দিকিন?”
ব্যোমকেশ চাপা স্বরে বলিল, “হুম, বার্মাফেরত ভাগ্যলক্ষ্মীটি ঝাঁপি একেবারে উপুড় করে দিয়েছেন।”
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুবিমল সান্যাল আসিয়া অভ্যর্থনা জানাইলেন। ভদ্রলোকের চোখ দুটি রক্তাভ, স্লিপিং গাউনটি ছাড়ার সুযোগ পাননি, মুখটি যেন আজ আরও শুষ্ক দেখাইতেছে। ব্যোমকেশ ধীরস্বরে বলিল, “যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে অমিয়র ঘরটি একবার দেখতে চাই।” সুবিমল ক্লান্ত স্বরে সম্মতিজ্ঞাপন করিলেন।
অমিয়র ঘরটি দ্বিতলে অবস্থিত, ছিমছাম এবং বেশ পরিপাটি করিয়া সাজানো। একটি বুক শেলফও আছে, সেখানে দর্শন এবং গণিতের কিছু ভারী ভারী বইয়ের পাশে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যর বইও নজরে আসিল। ব্যোমকেশ অমিয়র পড়ার টেবিলটি দেখিতেছিল। সেখানেও কিছু বই, কিছু কাগজপত্র। ব্যোমকেশ একটি বই হাতে তুলিয়া লইয়া দেখিতেছিল, নাম দেখিয়া বুঝিলাম প্লেগের চিকিৎসা নিয়ে লেখা। সুবিমলও আমাদের সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ব্যোমকেশ তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাইয়া বলিল, “এ বইটি দেখছি অমিয় বেশ মন দিয়েই পড়েছে, জায়গায় জায়গায় পেন্সিলের দাগ। প্লেগ নিয়ে কেন চর্চা করছিল তা কিছু জানেন?”
সুবিমল সামান্য চমকিত হইলেন। তারপর মাথা নাড়িলেন, “সে তো ঠিক জানি না। তবে আপনাকে বলেছিলাম যে ওর মা প্লেগে মারা গেছিলেন, সেই সূত্রেই বোধ করি ওই রোগ নিয়ে পড়াশোনা করছিল।”
ব্যোমকেশ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িল। টেবিলের লাগোয়া একটি দেরাজ, সেটির মধ্যে এক ঝাঁক হ্যান্ডবিল এবং রসিদ দেখা গেল। ব্যোমকেশ রসিদগুলো তদগত চিত্তে উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতেছিল। আচমকা প্রশ্ন করিল, “দেবদত্ত সাধুখান নামে কাউকে চেনেন নাকি? অমিয় এনাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে, অন্তত রসিদ তাই বলছে দেখছি।”
সুবিমলের মুখে দেখিলাম যথেষ্ট বিরক্তির উদ্রেক ঘটিল। “চিনি বইকি,” কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সুবিমল বলিলেন, “আপনার কাছে লুকোব না ব্যোমকেশবাবু। সম্প্রতি অমিয়র স্বভাবচরিত্রে কিছু পরিবর্তন এসেছিল, যার ফলে বাবা ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্কটি কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। এবং সেটার জন্য পুরোপুরি দায়ী এই লোকটি, দেবদত্ত।”
ব্যোমকেশ চকিত হইয়া বলিল, “আর একটু বিশদে আলোকপাত করতে পারেন?”
“এই দেবদত্তের সঙ্গে আমার ছেলের আলাপ রিগ্যালে, চৌরঙ্গীর এই ক্লাবটিতে ও যেতে শুরু করে গত বছরের শুরুর দিকে। শুরু শুরুতে সামান্য গানবাজনা, একটু আধটু টেনিস খেলা এইসবই করত। বিকাল সন্ধ্যা নাগাদ যেত, ঘণ্টা দুই-আড়াই কাটিয়ে চলে আসত। বছরখানেক আগে থেকে লক্ষ করলাম অমিয়র মাঝে মাঝেই বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হচ্ছে, দু-একদিন তো ফিরল প্রায় মাঝরাতের পর। প্রথম প্রথম প্রশ্ন করলে একটু বিব্রত হত, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। তখনই জেনেছিলাম দেবদত্তই ওকে নিয়ে নানা পাড়ায় ঘুরতে যেত। বাপের মন বুঝতেই পারছেন, নানারকম চিন্তা আসত। কিন্তু ওকে বিব্রত হতে দেখে খুব কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতাম না। যত দিন যেতে লাগল, বিব্রতবোধটা কেটে গিয়ে যেন একটা ঔদ্ধত্য চাগাড় দিতে লাগল, তারপর একদিন…” সুবিমলকে সামান্য দিশাহারা লাগিল, যেন মনস্থির করিতে পারিছেন না কথাটা আমাদেরকে বলিবেন কিনা।
খানিক চুপ থাকিয়া, সামান্য ধরা গলায় ফের বলিলেন, “একদিন ফিরল ভোররাতে, সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে। আমি জেগেই ছিলাম। অমিয়র অবস্থা দেখে গা জ্বলে গেল, কিছু কড়া কথা শোনালাম। জীবনে এই প্রথমবার অমিয় আমার ওপর গলা চড়াল। কী বলব ব্যোমকেশবাবু, চাকরবাকরদের সামনে আমার মাথা কাটা গেছিল সেদিন। সবার সামনে চেঁচিয়ে জানাল সারারাত সে কোথায় কাটিয়েছে, সে খারাপ জায়গার নাম আমি মুখেও আনতে চাই না। আরও কত যে অকথা কুকথা, সেসব আর নাই বা বললাম। সেদিনের পর থেকে আমিও আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করিনি ওকে, বাড়ি থেকে কখন বেরোত কখন ঢুকত সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। বলতে গেলে সেদিনের পর থেকে ওর সঙ্গে আমার আর ভালো করে কথাবার্তাই হয়নি। হয়তো আমারই দোষ, বাপের অহঙ্কার ত্যাগ করে আরেকবার ওর সামনে দাঁড়ালে আজ ওকে হয়তো হারাতে হত না।”
ব্যোমকেশ সহানুভূতিশীল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “এটি কতদিন আগের কথা?”
“তা ধরুন, মাসতিনেক তো হবেই।”
সুবিমল দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিলেন, “ওই দেবদত্ত স্কাউন্ড্রেলটির পাল্লায় না পড়লে এসব কিছুই হত না। আর আপনি তো নিজের চোখেই দেখলেন কীভাবে অমিয়র মাথা মুড়িয়ে চলেছিল। যত টাকা সে নিয়েছে অমিয়র থেকে, তার পুরো হিসেবও বোধ হয় নেই। কতবার যে বারণ করলাম ওকে, নিজের ছেলে না শুনলে আর কী করব।”
“আপনি দেবদত্তকে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, একবারই দেখা হয়েছিল। অমিয়ই নিয়ে এসেছিল ওকে এ বাড়িতে। প্রথম দর্শনেই আমার এত বিতৃষ্ণা জেগেছিল যে পরে লোকটি এ বাড়িতে এলেও আমি আর দেখা করিনি।”
ব্যোমকেশ হাতঘড়ির দিকে এক ঝলক দেখিয়া বলিল, “এ মুহূর্তে আর কোনও প্রশ্ন নেই, তবে হয়তো দু-এক দিনের মধ্যেই আপনার বাড়িতে একবার ফেরত আসতে হবে। ভালো কথা, ওই প্লেগের বইটি আমি নিয়ে যাচ্ছি। আশা করি আপনার অসুবিধা নেই।”
“স্বচ্ছন্দে নিয়ে যান। কিন্তু কী বুঝছেন ব্যোমকেশবাবু? অমিয়কে কীভাবে ফিরে পাব?”
ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক স্বরে বলিল, “এই মুহূর্তে কিছু বলা মুশকিল। কিছু জায়গায় যাওয়া দরকার, আরও খোঁজখবর চাই।”
সুবিমল সান্যাল সামান্য আশাহত স্বরে বলিলেন, “দেখুন কী করতে পারেন। মনে হচ্ছে পরের কিস্তির টাকার ব্যবস্থাও করতেই হবে, দুদিনই যা সময়।”
ব্যোমকেশ আর বাক্যব্যয় না করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সিঁড়ি দিয়া নামিয়ে যাওয়ার মুখে হঠাৎ সুবিমলের দিকে ফিরিয়া বলিল, “ভালো কথা। দ্বিতীয় যে চিঠিটি আপনার কাছে এসেছিল সেটি একবার দেখাতে পারেন?”
“হাতের কাছে তো নেই। আমি আপনার বাড়িতে আজ বিকালের মধ্যে পাঠিয়ে দেব।”
ব্যোমকেশকে নিয়ে প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্যাস্টিশ ‘গরল তমসা’-র নির্বাচিত অংশ তুলে দেওয়া হল এখানে। বইটিতে এক মলাটে আছে ফেলুদাকে নিয়ে প্যাস্টিশ ‘রাজধানীতে তুলকালাম’। প্রবীরেন্দ্রর কলমকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে অভীক কুমার মৈত্রর করা প্রচ্ছদ ও অলংকরণ।
উৎসাহী পাঠক এই লিংকে প্রি-অর্ডার করতে পারেন — http://sristisukh.com/ss_wp/product/রাজধানীতে-তুলকালাম/
করোনা লকডাউন শেষে আমরা অর্ডার অনুসারে বইটি পাঠানো শুরু করব।