অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে মায়ের লেখা পড়তে পড়তে নবনীতা দেবসেন পেয়েছিলেন এক দারুণ শিক্ষা– ‘লঘুস্বরে গুরু কথা বলা’। তাঁর উপলব্ধি, ‘এটা কেবল শিল্পেরই শিক্ষা নয়, জীবনেরও সম্বল।’ সেই একই কথা যদি সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়ের ‘অপার বসন্ত’ পড়তে পড়তে পাঠকের মনে পড়ে গেলে, অনুমিত হয়, বাংলা সাহিত্যের বহমানতায় ততটাও পলি পড়েনি যতটা হইচই হয় নাব্যতা নিয়ে। অত্যুক্তি নয়, বরং পাঠক খেয়াল করে খুশি হবেন যে, কীভাবে উত্তরসূরির থেকে শিক্ষা নিয়ে লঘুস্বরে গুরু কথা বলার শিল্পিত অনুশীলনে রত হয়েছেন সঙ্গীতা।
তাঁর লেখালিখিতে একদমই অপরিচিতের দূরত্ব নেই। তিনি পাঠককে ও পাঠক তাঁকে আপন করে নিতে পারেন সহজেই। বিগত বইগুলির ক্ষেত্রে তা প্রমাণিতও বটে। তবু সঙ্গীতা কিন্তু তাঁর অনুশীলনকে চেনা ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে রাখেননি। বিবৃতি থেকে ব্যঞ্জনায় উত্তরণে আখ্যান যখন শিল্পমুখী হয়ে ওঠে, অন্তত সে আভাস যখন দেখা যায়, তখনই কাহিনিকারের মুনশিয়ানা টের পাওয়া যায়। বস্তুত সেটুকুও এমন মোলায়েম যে আমাদের নজরেই পড়ে না, কত পরিকল্পিতভাবে আমাদের মগজ থেকে অনুভবে লেখক ছড়িয়ে দিলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বক্তব্যকে। এই কৌশল নিঃসন্দেহে আয়াসসাধ্য। এবং নিজেকেই সে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে সঙ্গীতা যে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন তা তাঁর চরিত্ররাই বলে দেয়। এই সময়টা যে বদলের তাতে সন্দেহ নেই। চারিদিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ‘মিটু’ আন্দোলনের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা নিয়ে সংশয় নেই। এমনকী মার্কিন মুলুকের নির্বাচনী ইতিহাসকে নতুন মাইলস্টোনের মুখে এনে এই প্রথম দুই কক্ষ মিলিয়ে সবথেকে বেশি সংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রথম আমাদের দেশে বিরাট কোহলিকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছেন মিতালী রাজ এবং তা নিয়ে অল্প হলেও আলোচনা হচ্ছে। এ এক সার্বিক বদলের হাওয়া নিশ্চিতই। কিন্তু এই পালটা হাওয়ার ভিতর কলম ধরে সঙ্গীতা কোথাও তথাকথিত নারীবাদের গল্প বলতে বসেননি। কিংবা তার সঙ্গে আর্বানিটি মিশিয়ে শৌখিন প্যাকেজ ফেমিনিজমের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠতে চাননি। বাস্তবিকই এ হয়তো তাঁর লক্ষ্যের মধ্যেই ছিল না। বরং তিনি ডুব দিয়েছিলেন সেই অসংখ্য জীবনের ভিতর, যা ইতিহাসে থাকে না, এমনকী মঙ্গলকাব্যও যাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে বিচলিত নয়। বলতে পারি, নিতান্ত সাধারণ ব্র্যাকেটে আমরা যাদের প্রায়শই ফেলে দিয়ে থাকি, এরাই সঙ্গীতার গল্পে চরিত্র হয়ে ওঠে। ঘটনাচক্রে তাঁদের অনেকেই নারী। এবং আমরা দেখি সঙ্গীতা তাঁদের জীবনের ভিতর থেকে যখন দু-এক আঁজলা জল তুলে আনছেন, তখন আমরা খুঁজে পাচ্ছি আর এক আকাশ। যে আকাশ উচ্চকিত নয়। কিন্তু বড় সূক্ষতায়, সাবলীলভাবে ও সময়ের নিরিখে খানিকটা অবধারিতভাবেই উঠে আসছে কলমের মুখে। তবে কাহিনিকার হিসেবে সেখানে আটকেও থাকেননি তিনি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তরে আর দেখেছেন, যুদ্ধের অতীত; কী যুদ্ধ চলে একজন মানুষের দেহে-মনে-আত্মায়। বস্তুত এই নিয়ত যুদ্ধের কথামালাই জীবন। এ যুদ্ধের ভিতর যত ঈর্ষাই থাকুক, যত শীতই থাকুক, তবু এ অপার বসন্ত আমাদের সভ্যতায় জলসিঞ্চন করে চলেছে। আর সে সব কথাই সঙ্গীতা বলতে পেরেছেন ওই লঘু স্বরে। ফলে তিনি পাঠকে বিস্মিত করেন, বিব্রত করেন। কিন্তু তা আচমকা নয়। বরং সমস্ত বক্তব্য, অনুভূতিই তিনি চারিয়ে দেন ধীরে তবু অব্যর্থভাবে। সঙ্গীতা বোধ হয় জানেন, লক্ষ্যে স্থির থাকতে গেলে হাততালির শব্দ থেকে সরিয়ে নিতে হয় মনকে।
এই বসন্ত তাই অপার, তবু অন্যরকম। অনুশীলন, চর্চায় সঙ্গীতা বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেননি বলেই আমাদের বিশ্বাস। আশা করি পাঠকের প্রতিক্রিয়া আমাদের সে বিশ্বাসের ভিতকেই মজবুত করবে।
Be the first to review “অপার বসন্ত”