সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণে অনেক সময়েই লুকিয়ে থাকে অবদমনের চিহ্ন, ক্ষমতায়নের চির-চেনা রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে কোনও সাহিত্য ঠাঁই পায় মূলধারায়। কোনও সাহিত্য ‘অপর’ (other) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। আবার কোনও সাহিত্য থেকে যায় বিচ্ছিন্ন, অপাঙ্ক্তেয়, পরিচয়হীন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, গুপ্তকথা নাম নিয়ে জন্মেছিল এক বিশেষ ঘরানার গদ্য-আখ্যান। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণে তাদের গায়েও লেগে থাকল উপেক্ষার দাগ। গুপ্তকথা গোত্রের বয়ানগুলি হয়ে উঠল অপাঙ্ক্তেয় বিচ্ছিন্ন এক সাহিত্য-সংরূপ। যদিও পৃথক
‘সংরূপ’-এর তকমা গুপ্তকথার কপালে জোটেনি মোটেই। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসও তাকে মূলধারার উপন্যাসের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসায় না। কিন্তু উনিশ শতকীয় ‘জনতোষ-সংস্কৃতি’১-র গুপ্তকথাগুলি এক অপরিহার্য অঙ্গ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টিমূলক গদ্যের স্ফুরণে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল বাংলা সাহিত্যের পাঠককুল। অনুবাদ, পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজনে রচিত গদ্য, বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ–প্রস্তাব প্রভৃতি পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য ধীর পায়ে এগোচ্ছিল তার ‘সর্বার্থসিদ্ধি’-র যুগের দিকে। লেখা হচ্ছিল প্রচুর নকশা, উপন্যাস-ধর্মী বা উপন্যাস হয়ে উঠতে চাওয়া বিভিন্ন গদ্য আখ্যান। এদের মধ্যেই ছিল গুপ্তকথা-জাতীয় রচনাগুলি। গুপ্তকথা-জাতীয় লেখা বলতে সেই আখ্যানগুলিকে বোঝান হচ্ছে যাদের নামকরণে লগ্ন হয়ে আছে ‘গুপ্তকথা’ শব্দবন্ধটি। অনেকসময়েই আত্মজীবনী বা জীবনীর ভঙ্গিতে রচিত এই গদ্য আখ্যানগুলির মর্যাদাসম্পন্ন উল্লেখ পাওয়া যায় না সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে।
গুপ্তকথা ধারার জনপ্রিয়তম এবং সম্ভবত আদি লেখক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর রচিত গুপ্তকথা গোত্রের লেখাগুলি হল, ‘তুমি কি আমার?’ (নবন্যাস; ১৮৭৩-১৮৭৯), ‘আশ্চর্য গুপ্তকথা’ (১৮৭৭-৭৮), ‘বিলাতি গুপ্তকথা’ (দুই খণ্ডে, ১৮৮৮-১৮৮৯), ‘বঙ্কিমবাবুর গুপ্তকথা’ (সহযোগী লেখক কৃষ্ণধন বিদ্যাপতি, ২ খণ্ডে, ১৮৯০), ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ (১৯০১), ‘রাজা আদিত্যনারায়ণের গুপ্তকথা’ (?) প্রভৃতি।
গুপ্তকথা ধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন পঞ্চানন রায়চৌধুরী। তাঁর এই জাতীয় কয়েকটি রচনা হল, ‘নবীন সন্ন্যাসীর গুপ্তকথা’ (১৮৯৬), ‘কুলকলঙ্কিনী বা কলিকাতার গুপ্তকথা’ (১৯০০), ‘সচিত্র হরিদাসীর গুপ্তকথা’ (১৯২০), ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ (১৯৩০) প্রভৃতি।
এ ছাড়াও এই ধারায় রচিত হয়েছে, বিনোদবিহারী বসুর ‘সরসীলতার গুপ্তকথা’ (১৮৮৩), শম্ভুনাথ বিশ্বাসের ‘ফচকে ছুঁড়ীর গুপ্তকথা’ (১৮৮৩), ননীলাল মুখোপাধ্যায়ের ‘ছোট বউর গুপ্তপ্রেম’ (১৮৮৩), মাখনলাল দত্তের ‘চিত্রগুপ্তের গুপ্তকথা’ (১৮৯৬), দেড়ে বাবাজীর ‘উদাসিনী রাজকন্যার গুপ্তকথা’ (১৯০৮), ‘কুল-কলঙ্কিনী’২, তারাকান্ত কাব্যতীর্থের
‘গুপ্ত-উপন্যাস’৩, কালীকুমার দত্তের ‘কেশব বাবুর গুপ্তকথা’ ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, উক্ত রচনাগুলির বাইরেও এই ধারায় প্রচুর লেখা হয়েছে। কালের প্রবাহে তারা অনেকেই বিলুপ্তপ্রায়।
গুপ্তকথার লুপ্তকথা
₹180.00
বিবস্বান দত্তের একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ গুপ্তকথার লুপ্তকথা।
book-author |
---|
Customer Reviews
There are no reviews yet.
Be the first to review “গুপ্তকথার লুপ্তকথা”