চামচিকড়ি

349.00

অভীক কুমার মৈত্রর লেখা এবং আঁকায় সমৃদ্ধ একট রম্য ছড়া সংকলন।

আমি কবি নই। অবশ্য আমি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, দায়িত্ববান আইসিএস অফিসার, বিলেতফেরত বিজ্ঞানপ্রেমী, প্রথিতযশা সাংবাদিক, জনপ্রিয় ইংরিজীর অধ্যাপক, বিখ্যাত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, বা শান্তিনিকেতনের প্রবাসী প্রাক্তনীও নই। কিন্তু যেহেতু আমি বাঙালি, তাই আমি মনে করি যে কবিতা মাধ্যমটির ওপর আমারও জন্মগত অধিকার আছে। এই দাবির জন্যে কোনও গুণগত মাপকাঠির প্রয়োজন হয় না; বাঙালি হয়ে জন্মানোই যথেষ্ট। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত দাবি থেকে এই বইয়ের ছাপার অক্ষরে জনসমক্ষে আসার সুদীর্ঘ পথটি, আর যাই হোক, অবশ্যম্ভাবী ছিল না। দু-চার কথায় সে বিষয়ে একটু বলে নিই। আপনারা চাইলে এই অংশটি সম্পূর্ণ বাদ দিয়েও যেতে পারেন, বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যেহেতু এটি আমার প্রথম (এবং খুব সম্ভবত শেষ) একক বই, তাই একটু স্মৃতিচারণ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এরকম সুযোগ তো আর পাবো না!
প্রথমেই বলি, খুব ছোটবেলা থেকেই আমার ছড়া-কবিতার জগতে প্রবেশাধিকার পাওয়া হয়ে গেছিল। আমার বাবা (pre-কৃত্তিবাস) কবিতাপ্রেমী হবার সুবাদে রবীন্দ্র-সত্যেন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-প্রেমেন্দ্র, এমনকি বিষ্ণু দে-র কবিতাও বাবার মুখে আবৃত্তি শুনে-শুনে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানে না বুঝেই)। কিন্তু ছড়ার ব্যাপারে আমার পথপ্রদর্শক ছিল আরেকজন খুব কাছের মানুষ: আমার ছোটপিসি। আমার মা-বাবা দুজনেই চাকরি করত বলে শৈশবে আমার সারাদিন ঠাকুমা আর পিসির সঙ্গেই কাটত। তাই আমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে মুখে-মুখে ছড়া শোনানো থেকে শুরু করে অক্ষরপরিচয়ের পর ক্রমে-ক্রমে ‘হাসিখুসি’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘হ-য-ব-র-ল’, ‘আবোল-তাবোল’ ইত্যাদি কিনে দিয়ে ছড়ার প্রতি আমার টানটা ছোটপিসিই তৈরি করে দিয়েছিল। সেই বয়েস থেকেই আমার কবিতা মুখস্থ করার সঙ্গে-সঙ্গে স্বরচিত ছড়া কাটার প্রতিভাও বিকশিত হচ্ছিল— যার চার দশক পরের অপ্রত্যাশিত পরিণতি হচ্ছে এই বইটি, যেটি আপনি হাতে ধরে আছেন (এবং কষ্টার্জিত অর্থের অপব্যয় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন)।
(এখানে একটু বিষয়ান্তরে যাচ্ছি: ছড়া আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী? আমি সাহিত্যের ছাত্র নই, তাই অ্যাকাডেমিক চোরাবালিতে তলিয়ে না গিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামতটুকুই দিতে পারি: ছড়া আর কবিতার মধ্যে প্রধান পার্থক্য তাদের দৈর্ঘ্যে এবং সহজবোধ্যতায়। বিষয়বস্তু যতই গভীর বা তির্যক হোক, ছড়াকে এমন সরল ও সংক্ষিপ্ত আঙ্গিকের হতে হবে যাতে তা প্রথম পাঠেই (বা শ্রবণেই) মাথায় গেঁথে যায়। এবং ছন্দ, মাত্রা, অন্ত্যমিল, শব্দচয়ন, সব মিলিয়ে ছড়ার মধ্যে এমন একটা চলন থাকবে যেটা আবৃত্তি করলে তো বটেই, মনে-মনে আওড়ালেও আপনা থেকেই পরিস্ফূট হয়ে উঠবে। কবিতার ক্ষেত্রে এগুলি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়— যদিও বহু কবিতাও এই শর্ত মেনে লেখা হয়ে থাকে।)
এবার আসি এই বইয়ের অনুপ্রেরণার ব্যাপারে। আমার প্রিয় দুটি ছড়ার বইকে এর প্রধান পূর্বসূরী বলা যেতে পারে: অমিতাভ চৌধুরী-রচিত ও পূর্ণেন্দু পত্রী-অলঙ্কৃত ‘ইকড়ি মিকড়ি’ (আনন্দ, ১৯৭১), এবং নিমাই চট্টোপাধ্যায়-রচিত ও দেবাশীষ দেব-অলঙ্কৃত ‘বাতিল জঞ্জাল’ (লালমাটি, ২০১০)। এদের মধ্যে প্রথমটি পারিবারিক সংগ্রহে থাকার সুবাদে ছোটবেলাতেই আমার কণ্ঠস্থ হয়ে গেছিল। দ্বিতীয়টির ব্যাপারে ২০১২ সালে এক ফেসবুকীয় বন্ধুর কল্যাণে অবগত হই, এবং পত্রপাঠ কলেজ স্ট্রীট থেকে সংগ্রহ করি। অবশ্য এই দুটি বই ছাড়াও আরও অনেকের কাছেই আমি ঋণী: বাংলা ও ইংরিজীর বহু তাবড়-তাবড় ছড়াকার (সুকুমার রায়/যোগীন্দ্রনাথ সরকার/অন্নদাশঙ্কর রায়/সুভাষ মুখোপাধ্যায়/পুরন্দর ভাট থেকে ল্যুইস ক্যারল/এডওয়ার্ড লিয়ার/অগডেন ন্যাশ/ডরোথি পার্কার/প্রাইভেট বল্ড্রিক), ‘পাঞ্চ’, ‘ম্যাড’, ও ‘ন্যাশনাল ল্যাম্পুন’-এর মতো বিদেশী ব্যঙ্গধর্মী পত্রিকা, এবং ‘ফ্লপ শো’, ‘ব্ল্যাকঅ্যাডার’, বা ‘ইয়েস মিনিস্টার’-এর মতো উচ্চমানের কমেডি সিরিজ। এদের থেকে হাস্যরসের উপাদান ছাড়াও যে মস্ত বড় শিক্ষাটি পেয়েছি, তা হল: “Nothing is sacred”। পবিত্র গাভীদের অভ্রংলিহ বেদীতে বসিয়ে ধূপধুনো দেবার দিকে সচরাচর জনমতের পাল্লা ভারি থাকলেও তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার মতো ঔদার্য্য যেন আমরা কখনও হারিয়ে না ফেলি। ভারতবর্ষে অন্ধভক্তির রসে জারিত ব্যক্তিপূজার যে সর্বগ্রাসী মধ্যযুগীয় মানসিকতা আছে— যার প্রভাব আমরা আমাদের রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়াজগৎ, সবেতেই প্রতিনিয়ত দেখতে পাই— তা দুর্ভাগ্যবশত উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, এবং বর্তমানে একটা উগ্র, হিংস্র, অশিক্ষিত চেহারা নিয়েছে। এটা পিছিয়ে-পড়া দেশ বা জাতির অতীতের অতিরঞ্জিত গৌরবের স্মৃতিবেদনা থেকে উদ্ভূত হীনমন্যতার উপসর্গ কিনা জানি না, কিন্তু যে-কোনো সভ্য সমাজের মাপকাঠিতে এটা অপরিণত মানসিকতারই পরিচায়ক। এই বইয়ের কোনও ছড়া যদি আপনাদের কারুর ব্যক্তিগত দেবদেবীর অঙ্গহানি করে থাকে, তাহলে তার জন্যে আমি দুঃখিত (কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থী নই)।
দেখতেই পাচ্ছেন যে ছড়া ছাড়াও এই বইতে যা আছে, তা হল ছবি অর্থাৎ অলঙ্করণ। সবকটি ছবিই এই বইয়ের জন্যে বিশেষভাবে আঁকা; ফেসবুকে বিজ্ঞাপনার্থে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া অন্য কোথাও এগুলি আগে ‘প্রকাশিত’ হয়নি। অবশ্য ছড়াগুলির ইতিহাস আরেকটু দীর্ঘ। পঞ্চান্নটি ছড়ার মধ্যে দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ১৯৯৯ সালের বর্ষা সংখ্যায় (সঙ্গে গেছিল আমারই আঁকা ড্রাকুলার অন্য একটি ছবি)। বাকিগুলির মধ্যে ৯০% ছড়া গত দেড় দশক জুড়ে বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে পোস্ট করা, বাকি ১০% ‘অপ্রকাশিত’ (মানে সরাসরি এই বইয়ের জন্যে লেখা)। ফেসবুকে বের-হওয়া ছড়াগুলি বহু লোকের মনোরঞ্জন করেছে, এবং তার থেকেও বেশি লোকের মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। পরিচিতরা অনেকেই (শুভানুধ্যায়ীরা বাদে) পরিহাসচ্ছলে এগুলিকে একত্র করে বই প্রকাশ করার কথা বলতেন, আমিও তাতে তাল দিতাম, কিন্তু সত্যি করে বই— এবং তাও আবার সচিত্র সংস্করণ— বের করার ব্রেনওয়েভটি (যতদূর মনে পড়ছে) প্রকাশক মহাশয়েরই। ছবিগুলি আঁকা শুরু করেছিলাম প্রায় বছরখানেক আগে, অন্যান্য কাজের ফাঁকে-ফাঁকে সময় বের করে। রোহণ যখন বই বের করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাল— এবং প্রকাশকসুলভ তাগাদা দিতে শুরু করল— তখন বাধ্য হয়েই আঁকার গতি বাড়িয়ে দিলাম (তাতেও শেষরক্ষা প্রায় হচ্ছিল না)। আপনারা দেখলে বুঝতে পারবেন যে এখানে আমি কোনও স্টাইলের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, যখন যেরকম ইচ্ছে হয়েছে তখন সেরকমভাবে এঁকেছি। তবে মোটের ওপর একটা আঙ্গিকের সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা আছে আগাগোড়া। তাছাড়া বইয়ের নাম এবং অঙ্গসজ্জার মধ্যে দিয়ে ‘ইকড়ি মিকড়ি’-র প্রতি সচেতনভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রচেষ্টাও করেছি। তাই বলে দয়া করে ভাববেন না যে আমি নিজেকে অমিতাভ চৌধুরী বা পূর্ণেন্দু পত্রীর সমগোত্রীয় বলে দাবি করছি। বরং অস্কার ওয়াইল্ডের সেই বিখ্যাত ইংরিজী বচনটিই— “Imitation is the sincerest form of flattery that mediocrity can pay to greatness.”— এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ছড়াগুলির মধ্যে কয়েকটিতে চেনা পঙ্‌ক্তির আভাস পাবেন; সেগুলি সজ্ঞানে করা pastiche। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আর জয় গোস্বামী থেকে আহরিত লাইনগুলি তো চিনতেই পারবেন; বইমেলা নিয়ে ছড়াটি উত্তমকুমার-অভিনীত ‘যৌতুক’ ছায়াছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত ও গাওয়া একটি গানের থেকে অনুপ্রাণিত (‘এই যে পথের এই দেখা’), এবং একই সুরে গাওয়াও যাবে। আর দ্বিপদী (couplet) ছড়াগুলি প্রধানত ‘খনা’ ছদ্মনাম নিয়ে লেখা আমার একটি চালু সিরিজের অন্তর্গত (যা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালে, আম্ফানের বা উম্পুনের অব্যবহিত পরেই)।
প্রিয় পাঠক (এবং পাঠিকা), অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিলাম, আর ধরে রাখব না। তবে যাবার আগে কিছু আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাই। প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই প্রকাশক শ্রীরোহণ কুদ্দুসকে, অর্থব্যয় করে এই বই ছাপার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো হঠকারিতা করার জন্যে। প্রিয় সুহৃদ এবং partner in crime শ্রীপ্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অল্প সময়ের মধ্যে একটি মনোজ্ঞ ভূমিকা লিখে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু শ্রীউজ্জ্বল চৌধুরী আমার ‘ইকড়ি মিকড়ি’-র কপিটি হারিয়ে গেছে জেনে তাঁর ব্যক্তিগত কপি থেকে পাতাগুলি সযত্নে স্ক্যান করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, নাহলে আমার সংগ্রহ অপূর্ণ থেকে যেত; তাঁর কাছেও আমি ঋণী। ছড়া ও ছবির সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করার সময়ে উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে সেগুলির মান বাড়ানোর জন্যে শ্রীমতী শ্রেয়সী দস্তিদার এবং শ্রীমতী অভিরূপা ভাদুড়ী ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন। এবং সর্বোপরি একটি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই আমার কাব্যরোগের অন্যতম গুণগ্রাহী ও উৎসাহদাত্রী কিন্নরকণ্ঠী শ্রীমতী সাহানা বাজপেয়ীকে। এছাড়াও অকপট ভালোবাসা ও ক্ষমাপ্রার্থনা রইল আমার আত্মীয় এবং বন্ধুবৃত্তের সেইসব দেবদূতপ্রতিম মানুষদের প্রতি, যাঁরা গত চার দশকের ওপর ধরে আমাকে (এবং আমার উৎকেন্দ্রিক সৃজনশীলতাকে) হাসিমুখে সহ্য করে আসছেন। এই বই যদি পাঠক-পাঠিকাদের ভালোবাসা পায়, তাহলে অচিরেই দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি (মতান্তরে হুমকি) দিয়ে বিদায় গ্রহণ করছি। নমস্কার!

পুনশ্চ : যদি আমাকে বইমেলা বা অন্য কোথাও দেখতে পান, স্বচ্ছন্দে অটোগ্রাফ চাইতে পারেন। আমাকে দেখতে গম্ভীর ও ভীতিপ্রদ লাগলেও আসলে আমি খুবই নরম মনের হাসিখুশি একজন মানুষ।

 

অভীক কুমার মৈত্র

Customer Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “চামচিকড়ি”

Your email address will not be published. Required fields are marked *