ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’
বললাম, ‘আমাকে? আমি তো এখানে নতুন এসেছি।’
ভদ্রলোক অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘না, ঠিক আপনাকে নয়, আপনার নামটা কোথায় যেন দেখেছি… ওহ, মনে পড়েছে, আমাদের হুগলিতে আপনার নামে একটা রাস্তা আছে।’
আমার নামে রাস্তা! পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তাঁকে অফার করলাম। তিনি একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘সেটা একটা এঁদো গলি, খাটা পায়খানার দুর্গন্ধ, দুপাশে জঞ্জাল— বহুদিন সারাই হয় না।’
আমার না-দেখা, আমারই নামে কোনও গলির এমন দুর্দশা শুনে দুঃখ পাওয়া উচিত কি না বুঝতে পারছিলাম না।
কলকাতায় এমন বহু গলি আছে, যেগুলোর শুরু ও শেষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চরকির মতো পাক খেয়ে, বড়ো রাস্তার এপার-ওপার করেও সে রাস্তা শেষ হয় না। সাঁইত্রিশ নম্বর বেচারাম নস্কর লেন খুঁজতে আমার ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লেগেছিল। পঁয়ত্রিশ নম্বরের পর দেখি গলিটা শেষ। অগত্যা পাড়ার লোকের শরণাপন্ন হলাম। একজন ধুতি-পাঞ্জাবি শোভিত মাস্টারমশাই চেহারার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই তিনি খানিক ভেবে বললেন, ‘আসলে বেচারাম নস্কর লেন উঠে গেছে।’
‘উঠে গেছে মানে, এ কি দোকান নাকি?’
তিনি বললেন, ‘পুরোটা ওঠেনি, খানিকটা বেচারাম, কিছুটা ক্ষুদিরাম, সামান্য অংশ বোধহয় সংহতি স্ট্রিট হয়েছে।’
‘তাহলে আমি কোথায় যাব?’
ভদ্রলোক বিস্তারিত দিকনির্দেশ দিয়ে দিলেন। প্রথমে ডানদিকে গিয়ে রাস্তাটা যেখান থেকে লেফট টার্ন নিচ্ছে, সেটা ছেড়ে ফের ডানদিকে এগোতে হবে। দুটো বাই লেন পার করে তিন নম্বর বাই লেন দিয়ে শর্টকাট করলে বড়ো রাস্তায় পড়ব। তার ডান ফুট ধরে একশো মিটার এগিয়ে ফের ডান দিকে বাঁক নিলে আমার উদ্দিষ্ট ঠিকানা।
তাঁর নিদের্শমতো পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঘুরপাক খেয়ে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়ালাম, সেটা সেই পঁয়ত্রিশ নম্বর বেচারাম নস্কর লেন। তখন সেই ভদ্রলোক সেখানে নেই। অন্য একজন লুঙ্গি পরে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই, খবরের কাগজ থেকে একটুও মাথা না তুলে, বাজখাঁই গলায় পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘কোনও অবলিক আছে?’
‘মানে?’
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘পুরো ঠিকানা না নিয়ে রাস্তায় বেরোন কেন? ওটা পঁয়ত্রিশ অবলিক সাঁইত্রিশ হবে। পাশের গলি দিয়ে ওদিকে চলে যান। এ বাড়ির এদিকটা পঁয়ত্রিশ, ওদিক সাঁইত্রিশ।’
একবার মফস্সল শহরে বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়ে ভোরবেলা ফার্স্ট লোকালে ফেরার কথা। ঘুম ভাঙতে যথারীতি দেরি হল। তৈরি হয়ে যখন বের হলাম তখন হাতে আর মাত্র সাত মিনিট, অথচ স্টেশন যেতে মিনিমাম পনেরো মিনিট লাগবে। বন্ধুটি আশ্বস্ত করে বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই, শর্টকাটে যাব।’ একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। ইটবাঁধানো রাস্তায় মিনিট তিনেক হেঁটে দেখি একটা বড়ো পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে রাস্তা শেষ। এবার? বন্ধুটি নিরুদ্বিগ্ন ভাবে বলল, ‘পাঁচিলটা টপকালেই ওপাশে দু নম্বর প্ল্যাটফর্ম।’
‘এত বড়ো পাঁচিল কী করে টপকাব?’
বন্ধুর কোনও টেনশন নেই। বলল, ‘সবাই যাচ্ছে, তুইও পারবি।’
কাছে গিয়ে দেখি পাঁচিল ডিঙোনোর সব ব্যবস্থা পাকা। একগাদা ভাঙাচোরা ইট দিয়ে পাঁচিলের গায়ে একটা ছোটো পিলার। ওইটাতে পা দিয়ে উঠতে হবে। নামার সময়ও ওদিকে একই সিস্টেম। পাঁচিলের গায়ে দড়ি বাঁধা একটা ছোটো বাক্স ঝুলছে, তাতে লেখা ‘ফার্স্ট এড বক্স। ডোনেটেড বাই নিত্যযাত্রী সমিতি।’
বন্ধুটি সাহস দিয়ে বলল, ‘এ রাস্তার নাম বিনা-টিকিট-গলি। তোর তো মান্থলি আছে, ঠাঁটসে যা, কেন পারবি না…’
হাতিবাগানে চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, একটি দুধের শিশু কোলে নিয়ে এক দম্পতি এসে জনৈক চাইল্ড স্পেশালিস্টের ঠিকানা জানতে চাইলেন। হাঁটলে সেই ডাক্তারবাবুর চেম্বারে পৌঁছোতে মিনিট দশেক লাগবে। কোলে বাচ্চা দেখে দয়াপরবশ হয়ে আড্ডার কেউ বলল, ‘পাশের গলি দিয়ে চলে যান, শর্টকাট হবে।’
বিল্টু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘না, না, পাশের গলিতে একদম না।’
আমরা অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
বিল্টু জবাব দিল, ‘ওখানে অনেকগুলো হোটেল রয়েছে, সবসময় প্রেশার কুকারের সিটি বাজছেই। বাচ্চা কাঁথা ভিজিয়ে ফেলবে।’
কর্তাটি হেসে ফেললেন। গিন্নি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘উনি ঠিক বলেছেন। বাচ্চা তো আছেই, বাচ্চার বাবারও সুগারের ধাত।’
Be the first to review “নিছক রসিকতা”