ক’দিন আগে কলকাতায় একটি পারিবারিক উৎসবে সায়ন্তিকার বাবার সাথে দেখা। আমাকে দেখেই নিমের পাঁচন খাওয়া মুখ করে সোফাতে বসলেন। টিভিতে তখন কোনও একটি সিনেমা চলছিল, যেখানে দুটি ছেলেমেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করে অসুখী দাম্পত্যে জড়িয়ে পড়েছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সায়ন্তিকার বাবা বললেন, “কখনও কখনও এক মুহূর্তের ভুলের ফসল সারাজীবন বইতে হয়, বুঝলে…”
আমি সপাটে বললাম, “হ্যাঁ। জলের মতো বুঝলাম।”
সায়ন্তিকার বাবা একটু থতমত খেলেন। তারপর অফিসিয়াল স্মার্টনেস বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী বুঝলে?”
আমি ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলাম, “বুঝলাম এই যে, আপনি একমুহূর্তের ভুল করেছিলেন আর সেই ভুলের ফসল হল সায়ন্তিকা যাকে আপনি তেইশ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন।”
হয় কাজের দিদির করা কফিটা ভালো হয়নি, নয়তো টিভিতে ছবি ভালো আসছিল না। নইলে অমন তেতো মুখ করে ভদ্রলোক আচমকা উঠে যাবেন কেন?
আজ দিনটা বেশ গোলমেলে। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে আজকের দিনে মেষজাতকের কুলোকের কথায় কান দিতে নেই। অথচ, আজ কী কুক্ষণে সায়ন্তিকার বাবার ফোন এল। আমার মতিভ্রম হয়েছিল অথবা গ্রহ বিপর্যয় ঘটেছিল নিশ্চয়, নাহলে ফোনটা ধরলাম কেন?
ধরেই যখন ফেলেছি, অগত্যা কালমেঘ খাওয়া মুখ করে বললাম, “ভালো আছেন কাকু?”
ওপার থেকে হাঁড়িচাচা মাফিক আওয়াজ এল, “ভালো তো থাকবই। ভালো থাকব না মানে? তুমি কি চাও যে আমি ভালো না থাকি?”
“ইয়ে মানে, ছি ছি, কী যে বলেন কাকু। আমি কেন চাইব না যে আপনি ভালো থাকুন। আমি তো সব সময় চাই যে আপনি আরও ভালো থাকুন। আপনার বকেয়া ডিএ একলপ্তে প্রাপ্তি ঘটুক। লুপ্ত যৌবন ফিরে আসুক। সাদা চুল কালো হোক। পেটের ব্যথা, অম্বল সেরে যাক…”
“কী হে ছোকরা… তোমার সাহস তো কম নয়। ইয়ার্কি করছ আমার সাথে। জানো আমি তোমার বাবার বয়সি?”
“তাই নাকি, জানতাম না তো… ইসস… আমি তো ভাবতাম আপনি জাস্ট থার্টি।”
“ফাজলামো হচ্ছে? শোনো খোকা, নেহাত আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে, নাহলে তোমায় উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিতাম। আর আমি তো বুঝতেও পারি না যে তোমার মতো একটা গণ্ডমূর্খের সাথে সায়ন্তিকা বাকিটা জীবন কাটাবে কী করে?”
আমি যে গণ্ডমূর্খ, এই সারসত্যটা আমার মাস্টারমশাইরা বহুকাল আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন। তবুও বিদ্যাসাগর মশাই তো কোনকালে বলে গিয়েছেন যে কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া আর গণ্ডমূর্খকে গণ্ডমূর্খ বলতে নেই। তাই হেব্বি রাগ হল। না হয় আমি একটা পাতি ইস্কুল মাস্টার আর সায়ন্তিকার বাবা একটা সরকারি বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর। তাই বলে অ্যাইসা অপমান? বাছা বাছা কিছু উত্তর মুখে আসছিল। সেগুলো চেপে দাঁত কেলিয়ে (মানে, ফোনে যতটা দাঁত ক্যালানো যায় আর কী), গলায় স্যাকারিন ঢেলে বললাম, “কাকু, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার সাথে গত তেইশ বছরের অভিজ্ঞতাই ওকে আমার সাথে বাকিটা জীবন কাটাতে সাহায্য করবে।”
Be the first to review “যৎকিঞ্চিৎ”