কৌশিক চক্রবর্তীর উপন্যাস “অন্তহীন বেদনাঋতু” ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী’ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম বেশ কয়েকদিন আগে। প্রথমবার পড়লাম। কিছুটা ঘোর, কিছু প্রশ্নের বিড়ম্বনা, ও একটা অতৃপ্তি কাজ করল। এই ধরনের উপন্যাস খুব একটা পড়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। ধরনটাই নতুন, স্বাদও ভিন্ন, প্রকরণ আলাদা। বইটা প্রায় দু-সপ্তাহ রেখে দিলাম। আবার পড়া শুরু করে ভাবতে ভাবতে এগোলাম ও শেষ করলাম। এবারে কিছু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। প্রশ্ন আগের চেয়ে অনেক কমে এল। আর কিছু মনে হওয়া জন্মালো। এরই প্রেক্ষিতে এই সামান্যটুকু। না, এ-কোনো আলোচনা-সমালোচনা নয়, নয় কোনো রিভিউ। প্রতিবেদনটি তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করে (যেমন লিখলাম) উপস্থাপিত করছি।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া
ক) ভালো লেগেছে। এক ভিন্নধরনের ভালোলাগা, সবটা যার কথা বলায় প্রকাশ করা যায় না। খ) বলার ঢং কাব্যিক। প্রায় গোটা উপন্যাসটাই। গ) বলার ভাষাও যথেষ্ট কাব্যিক। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল যেন টানা গদ্যে কবিতাই পড়ছি। আবার তার কেটেও যাচ্ছিল বিভিন্ন জাম্পকাটে ঘ) একটা ঘোর তৈরি করে দ্যায়। একটা মন কেমন করা। ঙ) এই ধরনের উপন্যাস আগে খুব একটা পড়িনি। বাংলাভাষায় বিভিন্ন ধরনের উপন্যাস লেখা হয়েছে ও হচ্ছে। এর মননশীলতা ও স্বাদ যথার্থই ভিন্ন। চ) ঘটনা-কার্যক্রম-ইতিহাস-কাহিনি নেই বললেই চলে। আছে উপর্যুপরী ভাবনাসকল। স্বপ্নাবেশ। ন্যারেটিভ। যে কাহিনির ছোপটি পেছনে কাজ করছে, তা তিন-চার লাইনেই সমাপ্ত হয়ে যাবে। ছ) উপন্যাসের চরিত্র হয়তো কিছু আছে, কিন্তু মুখ্য চরিত্রের চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন স্বপ্নভঙ্গ, শেষে প্রত্যয় ইত্যাদিই প্রধান। কিন্তু সেই চরিত্র ও পারিপার্শিক চরিত্র চিত্রণ সম্পূর্ণ মনোজগতের। তাদের ঘটনা বা কার্যাবলীর মাধ্যমে উদ্ঘাটিত করা নয়। তাদের মনস্তাত্ত্বিক জায়গাগুলোই উপন্যাস সৃষ্টি করেছে। জ) অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের প্রশ্নে অনস্তিত্বকেই খাড়া করে তুলে ধরার প্রয়াস না-থাকলেও, জীবনের অর্থহীনতার কথা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। যদিও অস্তিত্বের একটা বিশ্বময়তাও লক্ষনীয়। শেষে অর্থহীনতার মধ্যেও অর্থময়তাকে আবিষ্কারের একটা প্রচেষ্টা রয়েছে। ঝ) জীবন বিষাদময় ঠিকই, সেই বিষাদের আঁচ আছে ছত্রে ছত্রে, একটা ক্ষুদ্র বাসনা/স্বপ্ন না-পূরণের যন্ত্রণা এবং তদ্জনিত বিষাদময়তা ছেয়ে আছে উ্পন্যাস। চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে অন্তরটুকু পীড়া ও ভয়ের বা নিরাপত্তাহীনতার উৎপাদন বাড়িয়েছে ঞ) ‘অভি’ ও ‘আমি’ এই দুই চরিত্র একই, আমার হিসেবে, উপস্থাপনার গুণে ও প্রেক্ষিতে। বা বলা চলে সম্পূরক। এখানেও কিছুটা নতুনত্ব দেখতে পাই। বাকি চরিত্রগুলোও র্যালার মধ্যে এক ধরনের বিষাদাক্রান্ত, এবং তারাও যেন একক এক মহাচরিত্রের অংশমাত্র। ট) ভাবনা ও স্বপ্ন দৃশ্যে তথা কল্পে বা কার্যক্রমে ফ্যান্টাসি তৈরি করা হয়েছে, নানাভাবে, নানান অনুষঙ্গে ঠ) সবমিলিয়ে নাগরিক জীবনের কিছু মানুষ নিজের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে এই উপন্যাসের অবস্থান ও ভাবনাগত মিল খুঁজে পাবেন।
কিছু ব্যক্তি–প্রশ্ন
ক) এ-কে আমি উপন্যাস বলব কেন? এ-তো একটা সন্দর্ভ। অর্থাৎ বলতে চাইছি “টেক্সট” না-বলে নভেল কেন বলব? খ) এর ভাষা এত কাব্যিক কেন? গদ্যের ভাষা কি কবিতার ভাষা থেকে এক স্বতন্ত্র ভাষাগুণ সমন্বিত হওয়া উচিৎ নয়? একজন কবি উপন্যাস লিখছেন বলেই কি তাঁর গদ্যের ভাষার সঙ্গে কবিতার ভাষার পার্থক্য থাকবে না? গ) এত, মতো, মতন, যেন (প্রায় প্রতি পদে) কেন? এতে কি একটা একমুখী ঘোর তৈরি হয় না? এমনকি একটা সুররিয়ালিস্টিক অ্যাপ্রোচ? ঘ) কাহিনির বিস্তৃতি সেভাবে নাই থাকতে পারে, কিন্তু চরিত্র সৃষ্টি করলে, সেই চরিত্রের শুধুই ভাবনারাজি ও অতৃপ্তিরই প্রকাশ থাকবে, সেই ভাবনানুসারী সেভাবে কিছু ঘটনাবলী বা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা থাকবে না? থাকলেও তা যথেষ্ট কি? ঙ) কিছু পরিচ্ছেদ আছে (দু-তিনটে) যার সঙ্গে এই উপন্যাসের(?) কোনো যোগসূত্র সেভাবে আছে কি? যে কোনো প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো এইসব ভাবনাসকল ও মতামত নিয়ে ঔপন্যাসিক নিজেই কি নেমে পড়লেন না আসরে? এসব প্রশ্নগুলো আমার মনে জেগেছে। আমার মনে হওয়া দিয়ে নিজের মতো করে উত্তরগুলি খুঁজেছি, যা উপন্যাসকারের সচেতন প্রয়োগভাবনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলতে নাও পারে, বা অন্য পাঠকের ভাবনার সঙ্গেও। ফলে আমার ভাবনা ব্যক্তিভাবনার সম্ভবনাসমূহমাত্র।
আমার মনে হওয়া
ক) কোনো বিশেষ চলমান ঘটনাক্রম ছাড়া এ এক মানসভ্রমণ, যেখানে জীবনের অর্থময়তা খানখান করে ভাঙা হয়েছে এবং এক বিষাদময় জীবনের গান গাওয়া হয়েছে। সুতরাং জীবনপ্রবাহের কথাকে কথাসাহিত্যই ধরা উচিৎ। উপন্যাসের তথাকথিত ধাঁচাটিকে ভাঙা হয়েছে মনস্তাত্বিক অবস্থানসমূহকে প্রাধান্য দিয়ে। খ) উপন্যাসের ভাষা কাব্যিক হতে পারবে না, বা গদ্যের ভাষাবয়নকেই পাথেয় করতে হবে, এমন ফরমান যদি থেকেও থাকে, তবে তাকে অস্বীকার করার মধ্যেই উপন্যাসকার এক নতুন বার্তা দিতে চেয়েছেন সচেতনভাবে। হয়তো সীমারেখা ভেঙে ফেলাতেই এই উপন্যাসের ভাষা কাব্যিক হয়েও এক বিশেষ মাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। পড়ার সুখকে অস্বীকার করা যায় না। গ) ‘অভী’ বা ‘আমি’ বা ‘অন্যরা’ এই উপন্যাসে সর্বদাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা। প্রত্যয় সেভাবে নাই এইসব চরিত্রে। জীবনের অর্থহীনতার মধ্যে অস্তিত্বের সংশয় তাদের ঘিরে রাখে। তাদের ভাবনা ও দেখার মধ্যেও সেই ছাপ। প্রকৃতর চেয়ে আপাতর ভিন্ন ভিন্ন রূপ, অবস্থান, ঘোর ইত্যাদিতে তারা তাদের দ্যাখা ও চিন্তনকে এককভাবে আইডেন্টিফাই করতে পারে না। সম্ভবত তাই তাদের দ্যাখাকে, তাদের অবস্থানকে, নানাভাবে ব্যাখাত করতে হয়। আসে মতো, মতন, যেন ইত্যাদিরা। তাদের মনে হয় কিছুটা হলেও প্রকাশ করা গেল, এই তুলনা সাযুয্য ইত্যাদি তুলে এনে। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের ব্যক্ততা একটা ঘোর সৃষ্টি করে। হয়তো তা কিছুটা একমুখীন এবং সুররিয়ালিস্টিক, কিন্তু উপন্যাসকার সেটা রাখতেই চান সচেতনভাবে। ঘ) এই উপন্যাসে তথাকথিত কোনো কাহিনিমালা নেই। যা আছে, তা তিন লাইনেই সমাপ্য। যেমন— অভী, এক যুবকের ছোট্ট একটা স্বপ্ন— বারান্দাওয়ালা একটা ঘর, যেখান থেকে আকাশের তারা দ্যাখা যায়। সেই স্বপ্নের আশায় বেঁচে, যুগল (স্ত্রী, নিরু) তাদের ভ্রূণ-স্বপ্নকেই খুন করেছিল চার বছর আগে, জাস্ট লালনপালন ঠিকভাবে করতে পারবে না এই আশংকায়। যা থেকে ভয় এবং পালিয়ে বেড়ানো। কার্যত অভী, জীবনযুদ্ধে প্রায় পরাজিত সাবানগুঁড়োর সেলসম্যান। কায়ক্লেশে বাঁচে ও বিষাদগ্রস্ত। প্রাত্যহিক জীবনে কোনো পরিবর্তন না এলেও, স্বপ্ন অধরা থাকলেও, চারবছর পর তাদের বাঁচার ইচ্ছে জাগে নয়া গর্ভধারণের প্রেক্ষিতে। একটা প্রত্যয়ও কাজ করতে থাকে। কাহিনি বলতে এই-ই। এখন স্বপ্ন না-মেটা ও স্বপ্ন খুন করায় যে বাস্তবতাটুকু থাকে, তা বিশাল পৃথিবীতে নিজেকে আপনমনে বেমানান করে রাখার সামিল। সেখানে মনস্তাত্বিক যে অবস্থানগুলো পীড়িত করে, ভয়ার্ত করে, ফেরার করে রাখতে চায়, জীবনবিমুখ করে, বিষাদময়তায় ঠেলে দ্যায় তাকেই প্রায় বাধ্যত উপন্যাসকার তুলে আনেন। ফলে ঘটনার ঘনঘটা নয়, মনোজগতের আলোড়নই প্রাধান্য পেয়ে যায়। ঙ) অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মাঝখানে যেভাবে জীবনের অর্থহীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসরমান করা হয়েছে উপন্যাসে, তাতে একটা কালখণ্ড এক বিশাল কালখণ্ডের অংশমাত্র। আবার অস্তিত্ব অনস্তিত্বের প্রশ্নে ‘অভী’, ‘আমি’, ‘অন্যরা’, এমনকি ‘লেখক স্বয়ং’-ও একই চরিত্রভাবনার অংশীদার। প্রত্যেকের ক্ষুদ্র জীবনপ্রণালী যেন এক মহাজীবনের অংশ। তাই এরা প্রায় ভেদহীন। তাই লেখক স্বয়ং উপন্যাসে ঢুকলেন কি ঢুকলেন না, তা আর ম্যাটার করে না। কারণ অভী বা আমি ভাবলেও সেভাবেই ভাবত। চ) এই অর্থহীনতা ও বিষাদময়তা থেকে পরিত্রাণের কথা ভাবা হয়েছে একদম শেষে গিয়ে, নতুন করে বাঁচতে চাওয়ায়, পুনরায় নিরুর গর্ভধারণে, যা ইঙ্গিতময়। অসম্ভব কিছু নয়। বিচিত্র মানবজীবন সবসময় সবকিছু যুক্তি অনুসারে চলে না। এই বিচিত্রতা না-থাকলে মানুষ বাঁচতেও পারে না। হয়তো চার বছরের এই ফেরার-জীবনের অভিজ্ঞতাই তাকে আবার বাঁচার স্বপ্নে আশ্বস্ত করে। চ) কিছু পরিচ্ছেদে যেভাবে কলকাতা মহানগরীকে এবং তার নাগরিক জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে তার নিজস্বতাসহ তা বাহবা কুড়োবার যোগ্য। ছ) সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন মনে থাকবে এই উপন্যাসটা যার নাম ‘অন্তহীন বেদনাঋতু’। পাঠক পড়লে, যা হয়তো সার্থক হবে।
অন্তহীন বেদনাঋতু/ কৌশিক চক্রবর্তী/ সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী/ ১৬০ টাকা।