Description

‘গাছরে ধরিছে পেহারা ধরা মাগো
মাতা তো কাঁদিব জনম সারা মাগো
কাঁদিনে কাঁদিব দিন পনেরো মাগো
ছাতি কু করিব তামা পথর মাগো’

কিংবা

‘বড়দাদারে মুই কি থাইনু গেলিয়া ভোঁণ
দাদারে গেলিয়া পনস সজন গেলা দাদারে
মোকে কোঁন বিটায়া ঠেলিয়া দিল দাদারে’

এই পঙক্তিদের কাছে এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়। এই হু-হু কান্না, আকুতির ভাষা আমাদের যেন খুব চেনা, তবুও জানা নয় তেমন। আসলে আর্বানিটির অন্যতম শর্ত, সে মাপা হাসি-চাপা কান্নায় বিশ্বাসী। আনন্দ-শোক-উচ্ছ্বাসের চলকে ছলকে পড়াকে সে প্রশ্রয় দেয় না বরং পেয়ালায় মেপে নেয় অনুভূতি। ফলত এই স্বরচিত সফিস্টিকেশনের মোহে বাকি সবই গ্রাম্যতা হিসেবে কাব্যে উপেক্ষিত এবং এই ঘেরাটোপের ভিতরই তাই এহেন পঙক্তিদের আমাদের খানিকটা অচেনা লাগে। অথচ এ তো খুব জানা কথাই। স্বজনবিয়োগে কেমন আছাড়ি-বিছাড়ি করে কেঁদে ওঠে মানুষ। সে কান্নার অদ্ভুত এক টান আছে। সে কান্নায় যত বুক ফাটে, তত বেরিয়ে আসে স্মৃতি, জন্ম হয় কথার। আর ওই টান বা সুর মিশে শোকের আবহে সেই কথা রূপ পায় গীতের, কাঁদনাগীতের। যার জন্ম তাৎক্ষণিক। আয়ুও সামান্যই। ওই শোকপ্রকাশের ক্ষণটুকুতেই তার বিস্তার ও বৈভব। নির্দিষ্ট কোনও ফর্ম নেই, আবার দীর্ঘদিন চলতে চলতে একটা অবয়ব বা আদল পরিলক্ষিত হয় বটে। নিবিষ্ট গবেষণা সে স্বরূপটি ধরতে পারে। যেমন ধরেছেন বেবী সাউ। এই গীতের ভাষিক রূপ সন্ধানে বাংলা-বিহার-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ডের প্রান্তিক অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। বছর চারেকের পরিশ্রমে ভরে উঠেছে তাঁর সংগ্রহের ঝুলি, অভিজ্ঞতারও। শুধু নিখুঁত কাজের জন্যই আলাদা করে পড়াশোনাও করেছেন। এই গবেষণা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফসল ‘কাঁদনাগীত – সংগ্রহ ও ইতিবৃত্ত’। কাঁদনাগীত-এর উপর বিস্তারিত আলোচনা– উৎস, বিস্তার, লোকায়ত জনজীবন, ভৌগলিক পরিসীমার অবলুপ্তিতে এক অখণ্ড সাংস্কৃতিক পরিসীমার জন্মের ইতিবৃত্ত মিশে আছে এ বইয়ের পরতে পরতে। যা আমাদের ওই আর্বানিটির শর্ত অস্বীকার করে প্রতত করে বিপুলা জীবনের দিকে। বিষয় অভিনবত্বে এবং গবেষণার গভীরতায় নিঃসন্দেহে এটি একটি জরুরি, মূল্যবান ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বই হয়ে উঠতে চলেছে বলেই আমাদের বিশ্বাস।