১
এই লাইনটা এই গল্পের প্রথম লাইন। প্রথম লাইনে গল্পটা শুরু হল। দ্বিতীয় লাইনে চলতে শুরু করল। এই চতুর্থ লাইন যখন এল, তখন গল্পটা চলছে। চলতে চলতে চলতে চলতে চলতে — পঞ্চম লাইনের পর গল্পটা দেখল যে প্রথম অনুচ্ছেদ প্রায় শেষ। সামনে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ।
২
শীতের সকালে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
গল্পটা এসে তাকে ধাক্কাধাক্কি করে তুলে বলল, “আরে ওঠো ওঠো। এত ঘুমোলে চলবে?”
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, “ওঃ, এই সাতসকালে কেন জ্বালাতন করছ? কী চাই তোমার?”
গল্পটা বলল, “দু-একটা চরিত্র-টরিত্র দাও, নইলে চলি কী করে?”
“কীরকম চরিত্র দরকার? বাজেট কত?”
“মানে?”
“আরে চরিত্র তো তেত্রিশ হাজার আছে। কেমন ধারা চরিত্র লাগবে সেটা কিছু ঠিক করেছ? নাকি ওমনি ড্যাং ড্যাং করে চলতে শুরু করেছ? পৌরাণিক চরিত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র, আধুনিক চরিত্র — ছেলে না বুড়ো, স্বদেশী না ফরেন? সেসব ঠিক করো আগে, তারপর দেখা যাবে’খন!”
এই বলে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ পাশ ফিরে ফের কম্বল মুড়ি দিল।
গল্পটা বলল, “বাজেট মানে?”
কম্বল সরিয়ে মুখ বার করে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ বলল, “মানে? ন্যাকামি হচ্ছে? তুমি কি বিনি পয়সায় চরিত্র চাও নাকি? ওসব হবে নাকো। ভাগো। চরিত্রের বাজার এখন হেভি চড়া। সবে পুজো কাটল। এরপর বইমেলা আসছে। পকেটের অবস্থা কেমন?”
গল্প পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে বলল, “দাঁড়াও দেখি। আধুনিক চরিত্র একটা কত পড়বে?”
“শুধু আধুনিক বললেই চলবে নাকি? কী চরিত্র বলতে হবে তো! আধুনিকের ডিমান্ড বেশি। গোয়েন্দা সবচেয়ে চড়া। বাজেট কম হলে পৌরাণিক ট্রাই করতে পারো — এখন আর কেউ চায় না। ওই তাকে দেখো রেটকার্ড ছাপানো আছে। সব আলাদা বিভাগ আছে।”
“ও বাবা, রেটকার্ড কী গো! এ তো দেখছি পুরো টেলিফোন ডিরেক্টরি!”
“হবে না! চরিত্র কি কম? বললাম না, তেত্রিশ হাজার।”
“অত আমার সময় নেই খোঁজার। পার্সে দেখছি পঁচিশ টাকা আছে। ভালো কী পাওয়া যায় বলো তো এতে?”
“পঁচিশ টাকা? হাঃ হাঃ! আর হাসিও না। পঁচিশ টাকায় চরিত্র? সে তো কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে হত! তিন পয়সার পালা, এক পয়সার মা। পঁচিশ টাকায় যে দু’কেজি আলুও মিলবে না! আর তুমি কিনা চরিত্র চাইছ?”
“তা হলে কী হবে?”
“কী আর হবে? চরিত্রের খোয়াব ছাড়ো। ক্ষমতা থাকলে চরিত্র ছাড়াও গল্প হয়। শরৎবাবু লেখেননি ‘চরিত্রহীন’? খামোখা আমার ঘুমটার বারোটা বাজালে।”
“না না, কিছু একটা তোমায় করতেই হবে। শুরু করার পর এতটা চলে এসেছি যখন, শেষ অবধি তো যেতেই হবে। এখনও চরিত্রই দিলে না তুমি। এমন করলে গল্প দাঁড়ায়?”
“ঘ্যানঘ্যান কোরো না তো! দাঁড়িয়েই তো আছ সেই থেকে। শোনো, মনুষ্যচরিত্র পঁচিশ টাকায় পাবে না কোথাও। গরু-ছাগল চলবে? বাঘ-ভাল্লুক-হাতিও পেতে পারো, কিন্তু মারতে পারবে না; বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন আছে। আরও কমে চাও তো আরশোলা, ফড়িং, টিকটিকি, মাকড়সাও নিতে পারো। ওই ছোট নীল রঙের ডাইরিটা দেখো, রেট পেয়ে যাবে।”
“গরু-ছাগল যে নেব, চরাবে কে? রাখাল বালক দেবে তুমি? বাঘ-ভালুক নিলে তো আবার শিকারি চাই। না হয় আনাড়ি শিকারিই দাও, গুলি লাগে না, ফসকায়। মানুষ ছাড়া কি গল্প হয়?”
“তা হলে এক কাজ করতে পারো। বারোয়ারি চরিত্র কিছু ভাড়া নিয়ে যাও। সস্তা পড়বে। মৌলিক চরিত্র দিতে পারব না।”
“বারোয়ারি চরিত্র কীরকম?”
“আরে বাবা, রাজা রানি রাজপুত্র রাজকন্যে মন্ত্রী রাক্ষস খোক্কস এরকম জেনারেল চরিত্র আর কী! আধুনিকও আছে — সাধুবাবা, চোর, পুলিশ, লেখক… দু-একটা বাঘ-ভালুকের সঙ্গে রাজপুত্রকে লড়িয়ে দাও না, দেখবে গল্প জমে যাবে।”
“বাঘ-ভালুক তো বলছ মারা যাবে না। রাজপুত্র করবেটা কী?”
“সে কী করবে না করবে আমি কী জানি? মানুষ মানুষ করে হেদিয়ে মরছ, তাই বললাম।”
“না না, তার চেয়ে বরং একটা কুকুর আর একটা হনুমান দাও আমায়। দুটোয় কত পড়বে?”
“যেমন তোমার মর্জি। তাই নাও। দশ-দশ কুড়ি টাকা। মানুষ চাই না বলছ? বাকি পাঁচ টাকাটা কী করবে?”
“পাঁচ টাকায় কি আর ভালো কিছু পাওয়া যাবে? বেকার খরচা করে কী লাভ?”
“ঠিক আছে, না হয় রেখে দাও এখন। কুকুর আর হনুমান দিয়ে দিচ্ছি। শুরু তো করো! তারপর হাওয়া বুঝে মাঝখানে কিছু বারোয়ারি চরিত্র পাঠিয়ে দোব’খন, ওই পাঁচ টাকায় যা হবে।”
“বেশ, তাই সই। এই নাও কুড়ি টাকা। কই, আমার চরিত্রেরা কোথায়?”
“আরে, তৃতীয় অনুচ্ছেদে গিয়ে প্লট ঠিক করো আগে, তারপর তো চরিত্র! ঠিক সময় পাঠিয়ে দেব, চিন্তা নেই।”
৩
বাড়ির উঠোনে আরামকেদারায় বসে রোদ পোয়াচ্ছিল তৃতীয় অনুচ্ছেদ।
গল্পকে কাছাকাছি আসতে দেখেই বলে উঠল, “আরে এসো এসো, প্লট চাই বুঝি? তা নাহলে আর আমার এখানে আসাই বা কেন! আসতে তো হবেই বাবা! প্লট ছাড়া এগোবে কী করে?”
গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই গল্প লক্ষ করেছিল, দেওয়ালে টাঙানো এক সাইনবোর্ডে লেখা আছে — ‘হরেকরকম রেডিমেড প্লটের বাজার। চটপট কিনুন আর ফটাফট লিখে ফেলুন আপনার পছন্দসই কাহিনি’। দেখেই মনে মনে প্রমাদ গণেছিল সে। এও দেখি কেনার কথা বলে! পকেটে তো আছে মোটে পাঁচ টাকা আর! তাও বুকে সাহস এনে, একটু গলাখাঁকারি দিয়ে সে বলল, “হ্যাঁ, কই দেখি, একটা জমজমাট প্লট দিন তো।”
আরামকেদারা ছেড়ে উঠে তৃতীয় অনুচ্ছেদ বলল, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। জমজমাট প্লটের কোনও অভাব আছে নাকি আমার কাছে? চলো বাড়ির ভেতর, ঘুরিয়ে দেখাই সব। এই দেখো, সামনের এই ঘরে আলমারির তাকে তাকে যা সাজানো দেখছ, সব হল গোয়েন্দা গল্পের প্লট। আর এই ডানদিকের ঘরে তাক-বোঝাই সব রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ। ওদিকে উত্তরের ঘরে সব ভূতের গল্পের প্লট, মুখোমুখি দক্ষিণের ঘরে কল্পবিজ্ঞান। এগিয়ে এসো আমার সঙ্গে, এই যে এই ঘরে সব রূপকথা, এ ঘরে অভিযান, ওই ঘরে শিকারকাহিনি, তার পাশে হাসির গল্পের ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলাতেও ঘর রয়েছে একটা, তবে ওপরে ওঠার তেমন দরকার পড়ে না কারও, নিচেই দিব্যি পছন্দ হয়ে যায়।”
“কী আছে ওপরের ঘরটায়?”
“ও ঘরটার নাম ‘বিবিধ’। ওর প্লটগুলোকে নিচের কোনও ঘরে ফিট করা যায়নি, তাই ওপরের ঘরে তুলে রাখা আছে। দামও কম, ডিসকাউন্ট আছে। বিক্রি নেই কিনা তেমন, তাই।”
গল্পের মনে একটু আশার আলো জাগল। জিগ্যেস করল সে, “কোন প্লটের দক্ষিণা কেমন?”
তৃতীয় অনুচ্ছেদ সিঁড়ির নিচে ঝোলানো একটা নোটিসবোর্ড দেখিয়ে বলল, “এই তো রেট চার্ট টাঙানো রয়েছে। সবরকম প্লটের রেটই আছে। তবে দু-তিন রকম মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে চাইলে একটু হিসেব করে বলতে হবে। এই যেমন চল্লিশ শতাংশ ভৌতিকের সঙ্গে তিরিশ শতাংশ কল্পবিজ্ঞান, বাকিটা অভিযান কিম্বা রূপকথা — সেরকমও অনেকে নেয় কিনা!”
রেট চার্ট দেখেই গল্প বুঝে গেল এ জায়গা তার জন্য নয়। এমনকী বিভিন্ন বিভাগে ডিসকাউন্ট দিয়েও যা দাম মালুম হচ্ছে, সে তার নাগালের বাইরে। পকেটে পাঁচ টাকা পড়ে আছে শুনলে তৃতীয় অনুচ্ছেদ তো হেসেই কুটিপাটি হয়ে যাবে। তাও হাবেভাবে কিছু প্রকাশ না করে গম্ভীরভাবে বলল সে, “হুম, বুঝলাম! নাঃ, ঠিক পছন্দ হল না! ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ, চললাম।”
তৃতীয় অনুচ্ছেদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “সে কী! চললাম মানে? চলবে কী করে প্লট ছাড়া?”
“দেখা যাক! এ অবধি যেমন এসেছি সেভাবেই এগোই না! চলতে চলতে যদি কোনও প্লটের খোঁজ মেলে দেখি!” এই বলে গল্প তৃতীয় অনুচ্ছেদ ছেড়ে বেরিয়ে এল।
====================
প্লট ছাড়াই কী করে গল্পটা এগোল এর পর? জানতে হলে পড়তে হবে তাপস মৌলিকের ‘আজে গল্প বাজে গল্প’। প্রকাশিত হয়েছে টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪-এ।
গল্পের ছবি এঁকেছে অরিজিৎ ঘোষ।