বাপির যাওয়ার ডাক এল খুব জলদি। যেদিন চলে গেল বাপি, সেদিনই যেন হঠাৎ করে অনেকটা বয়স বেড়ে গেল মামুর। কেবল ঘুরেফিরে মাথা নাড়ে আর বলে, “আমায় ‘গোরাবাবু’ বলে আর কোনোদিন ডাকবে না কেউ!” আমোদিনী চায়ের কাপটা মুড়ির বাটিটা নিয়ে সামনে যায়। এখন তো সে আর ছোটটি নেই। দুজনেই নিঃশব্দে চোখ মোছে। কাজকম্ম মিটিয়ে ফেরার সময় আমোদ মামুর হাত ধরে বলে, “সাবধানে থেকো মামু। তুমি ছাড়া…”
মামু ধমকে বলে, “ওসব বলে কাঁদাবি নাকি আবার আমাকে! আমি ঠিক থাকব। তুমি ঠিক থেকো, মা-কে দেখো…”
আমোদিনী আশ্বস্ত হয়। মামু তো বলেইছে ঠিক থাকবে। শুধু খেয়াল থাকে না যে কতদিন ঠিক থাকবে সে হিসেব নেওয়া হল না তো!
কোনোদিন রাত্রে ফোন করে। মামুই ধরে। দরাজ গলায় পর পর ফিরিস্তি দেয় সুস্থ থাকার। “প্রেশার সুগার সব নর্মাল বুঝলি! মাঝে মাঝে ওই ইউরিক অ্যাসিড…”
আমোদিনী নিশ্চিন্ত হয়। মাইমাকে জিজ্ঞেস করে, “কী করছিলে?”
মাইমা বলে, “কী আর করব বলো! সেবা করছিলাম। সন্ধে হল তো কেবল মাথা টিপে দাও, পা টিপে দাও, আঙুল টেনে দাও… সর্বাঙ্গে কেবল ব্যথা। বিয়ে করে এনেছে তো সেবা করাতেই…”
আমোদিনী ভাবে এই বুঝি প্রেম। মাইমার এই হাসি-হাসি গলায় অভিযোগ, মামুর বাজার থেকে ফিরে গেট থেকে হাঁক — “কইইইই! বাজারটা ধরো-ও-ও।”
লোকে অবশ্য এটাকে প্রেম বলে না, বলে অভ্যেস। আমোদিনীর মনে হয় এটাই প্রেম। আসলে প্রেমের প্রকাশও পালটেই যায় প্রতি বিবাহবার্ষিকীতে।
শেষ যেবার ফোন করল আমোদিনী, মামু বলল, “কবে আসবি? শীতের সময়টায় আয়। নবান্ আছে তো! লালচে ভালো মন্ডা আনাব। আসবি তো?”
আমোদিনী আশ্বাস দেয়, “আসব ঠিক…”
কিন্তু নবান্ন কবে যে পেরিয়ে যায়। শীতও আসছি-আসব করতে করতেই হারিয়ে যায়।
তারপর এক শীতের শেষে মা তড়িঘড়ি কাটোয়া যায় দাদার শরীর ভালো নেই বলে। পাঁচদিন পরে খবর আসে মামুকে আসানসোলে নিয়ে যেতে হল নার্সিংহোমে ভর্তি করতে। আমোদিনী শুয়ে শুয়ে ভাবে আসানসোল! মামুর প্রেমের প্ল্যাটফর্ম! কতটা অসুস্থ মামু? আসানসোলে পৌঁছে কি সেইসব দিন মনে পড়ছে মামুর! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে আসে। ভোর রাতের ফোন কখনও ভাল খবর আনে না। ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলেই খবর পায় মামু নেই। প্রেমিক মামু, দাপুটে মামু, মজারু মামু ভ্যালেন্টাইন দিবসে প্রেমিকাকে ফেলে পাড়ি দিয়েছে কোন অজানায়।
আলো ফোটার সাথে সাথে রওনা হয় আমোদ। পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা হয়। সোজা শ্মশানে যায় তাই। সেখানে মামু শুয়ে আছে অনন্তের দুয়ারে। যে মামু কথায় কথায় হাঁক দিকে কানের পোকা নাড়িয়ে দিত, যে মামু ভোর পাঁচটায় উঠে আওয়াজ করে করে সব জানলা খুলে আমোদিনীদের ঘুম-টুম ভাঙিয়ে নিজে খালি বিছানায় আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, যে মামু নাক ডাকতে ডাকতেই কথা বলতে পারত, সেই মামু এক অসীম নৈঃশব্দ্যে হারিয়ে গেছে বাপির মতোই।
সব নিয়ম মেনে চিতায় শুইয়ে দেয় ওরা মামুকে।
আমোদিনী জিজ্ঞেস করে, “অমন উপুড় করে শোয়াচ্ছেন কেন?”
কে একজন বুঝিয়ে দেয় — “এ তো ইলেক্ট্রিক চুল্লি না, কাঠের চিতা। অনেক সময় লাগবে এমনিতেই। তার ওপর নাভিটা পুড়তে সময়ও লাগে… উপুড় করে দিলে…”
বুঝে নেয় আমোদ। সরে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে। সেখান থেকেও দেখা যায় দাউ দাউ আগুন… চারপাশে কালো ধোঁয়ার মেঘ। অভাগী নাকি ওই ধোঁয়ায় স্বর্গের রথ দেখেছিল।
আমোদিনী দেখে একখানা বেঞ্চ। সাদা… তাতে বাপি বসে তার চিরাচরিত সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে। মামুকে দেখে উঠে দাঁড়াল। হাতের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একখানা ফিল্টার উইলস বার করে বাড়িয়ে ধরে হাসল — “এলে গোরাবাবু? নাও…”
মামু সিগারেটটা হাতে নিয়ে বলল, “আগুনটা…”
বাপি কেমন অন্যরকম হাসে। চিতার লকলকে আগুনটা বাপিকে আর মামুকে আড়াল করে দেয় একটু।
মৃত্যু জানে আমোদ, মৃত্যুর পর জানে না… তবে তা যদি আদৌ থাকে, তবে বাপি আর মামু নিশ্চয় আজ সারারাত গল্প করেই কাটাবে সেই পৃথিবীর জীবনের মতোই।
=======
আমোদিনীর আরশি
সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়
প্রচ্ছদ – সুমিত রায়
সৃষ্টিসুখ প্রকাশন