Blog

গুচ্ছ খোরাক-সংহিতা মুখোপাধ্যায়

সংহিতা মুখোপাধ্যায়ের ‘গুচ্ছ খোরাক’ বই থেকে ‘সুকন্য বৃত্তান্ত’ গল্পটির অংশবিশেষ।

প্রাপ্তিস্থান — https://goo.gl/wYkNMj
================================================

সুকন্যা সত্যিই ভালো মেয়ে। তার মা বলেন, “ওকে কোনওদিন বলতে হয়নি ‘পড়তে বোস।’ কোনওদিন কোনও বায়না ছিল না ওর। যা খেতে দিয়েছি, তাই খেয়েছে। যে জামা পরতে বলেছি, তাই পরেছে। ফ্যাশন নিয়ে মোটে মাতামাতি ছিল না ওর…” তার বাবা বলেন, “মেয়েটা বড়ো ঘরকুনো, মুখচোরা ছিল। তাই লাইব্রেরিতে মেম্বার করে দিয়েছিলাম। তাও মেয়েটা অমিশুক, চুপচাপ রয়ে গেল।”

সেই সুকন্যা ভালোই আছে। বিগড়েও যায়নি, খারাপও হয়নি; একটুও না। আসলে সুকন্যা খারাপ হতে পারে না। এটাই তার গলতি। সেই যে ‘ভালোতে মন্দতে মিশিয়ে মানুষ’ বলে না, সুকন্যারও তাই। সে সত্যিই ভালো আর এই যে সে খারাপ হতেই পারে না এইটাই তার মন্দ। এ কথাটা সুকন্যা টের পেয়েছিল বেশ অল্প বয়সেই; সেই যখন সুকন্যা আর তার ভাই গুপি এক থালায় ভাত খেত, তখন। গুপির মুখে ভাতের দলা দিলে সে খেলাচ্ছলে ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছিটিয়ে দিত। মা অমনি চোখ বড়ো বড়ো তাকাতেন গুপির দিকে আর গলার স্বর গাঢ় করে বলতেন, “ছি গুপি, খাবার নষ্ট করতে নেই। জানো কত লোকে খেতে পায় না? তুমি খেতে পাচ্ছো বলে মুখের ভাত দালানে ছেটাবে? তুমি না বুদ্ধিমান, কখনও এরকম করবে না আর।” গুপি কিছুক্ষণ পরে ভুলে গিয়ে আবার ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছেটাতে শুরু করত। তখন মা মনে করানোর চেষ্টা করতেন যে গুপিকে মা কী শিখিয়েছেন। তার পরেরবার গুপি কানমলা খেত। তার পরেরবার কিল। তখন কাঁদত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত। তারপর সব ভুলে যেত আবার।

সেই সময় একদিন আঁচাতে গিয়ে সুকন্যা দেখেছিল কলঘরের নর্দমার মুখে বেশ দশ-বারো দানা ভাত পড়ে আছে। সুকন্যার আগে তার দাদু আঁচিয়ে ছিলেন সেখানে। তাঁর হাত থেকেই সম্ভবত পড়েছিল ভাতের দানাগুলো। সুকন্যা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর মায়ের অনুমতি চেয়েছিল, “মা, এই ভাতগুলো হাঁড়িতে রাখব?” মা জানতে চেয়েছিলেন, “মানে? কোন ভাত?” উত্তর শুনে বলেছিলেন, “না, রাখবে না।” শুনেই সুকন্যা ভাতের দানাগুলো মুখে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ একটা জোরালো কিল তার পিঠে এসে পড়েছিল। সন্ধেবেলা বাবা বাড়ি ফিরতে মা নালিশ করেছিলেন, “তোমার মেয়ের কাণ্ড জানো? সে নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে। আমি যেন তাকে পেট ভরে খেতে দিই না।” মা একটু শান্ত হতে বাবা সুকন্যাকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, “অমন নোংরা থেকে ভাত খুঁটে খেলে কেন তুমি?” সুকন্যা ঢোঁক গিলে বলেছিল, “অনেক লোক যে খেতে পায় না, তাই তো ভাত নষ্ট করতে নেই… মা বলেছিল যে।” মা চেঁচিয়ে উঠে আবার এক ঘা দিয়ে বলেছিলেন, “আমি নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খেতে বলেছি?”

সেদিন সুকন্যা বেশ বুঝেছিল যে সে কিছুই বোঝেনি। ‘খাবার নষ্ট করতে নেই’ মানে ‘ফেলতে নেই’; কিন্তু ফেলে দেওয়া খাবার তুললে দোষ হয়। কী-করতে-হয় আর কীসে-যে-কী-হয়-এর দুর্বোধ্যতায় সে শুধু শুনতে শুরু করেছিল। না প্রশ্ন করলে উত্তর দিত না। আর না করতে বললে কোনও কাজ করত না। তাকে একটা কাজ করতে বললে সেই কাজের আওতায় কী কী পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে তবে সে কাজটা করত। আবার প্রত্যেক ধাপে কাজটা ঠিক হল কিনা জেনে নিত। এভাবে কৈশোর নাগাদ সে বাধ্য, বিনয়ী আর কুশলী হয়ে উঠেছিল সবার বিচারে। কিন্তু সেই সবার মধ্যে কে কে ছিল না সেটাও সুকন্যা জানত। এই জানার একটা বোনাসও ছিল। বোনাস বোধি হল সাধারণ বিশ্বাস: “যারা বলে কম, তারা শোনেও কম।” সেই কারণেই কেউ কেউ তার সামনেই বলত, “সুকন্যা বিনয়ী না ছাই। কথা বলে না কারুর সাথে এ তো অহঙ্কার! নেহাত কাজেকম্মে, লেখাপড়ায় ভালো তাই কেউ কিচ্ছু বলে না। না হলে…” আর এভাবেই তিলে তিলে গড়ে উঠছিল জগৎ সংসার সম্বন্ধে তার ধারণার পুঁজি।

কিন্তু সে পুঁজি যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎ, সেটা সুকন্যা টের পেয়েছিল কলেজে গিয়ে। সেখানে উঁচু ক্লাসের দাদারা বলে, “সে কীরে? তুই বাইসাইকল থিভস দেখিসনি! তুই কী গাঁওয়ার? তুই কামু পড়িসনি, কাফকা পড়িসনি! তুই তো অমানুষ, জানোয়ার।” উঁচু ক্লাসের দিদিরা বলল, “এ মা! তুই কাজল পরিস না! কী বিশ্রী বোকা বোকা লাগে। একটা লিপগ্লস তো লাগাবি, কেমন ভিখিরির মতো ফাটা ঠোঁট তোর।” এসব কথার কোনও উত্তর সুকন্যার জানা ছিল না। আর তাছাড়া নিরুত্তরে বোনাস বোধি পাওয়ার লোভও ছিল।

কিন্তু কলেজের বোদ্ধাব্রিগেড চমকে গিয়েছিল যখন সুকন্যা আন্তর্কলেজ তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন আর বিতর্কে রানার্স আপ হয়েছিল। এক দিদি ব্যাগের ভেতর থেকে ব্যাগ, তার ভেতর থেকে আরেকটা ব্যাগ বার করে একটা লিপস্টিক দিয়ে বলেছিল, “এটা লাগিয়ে প্রাইজ নিতে উঠিস স্টেজে। ভাঙবি না, এটা টিউশনের পয়সায় কেনা।” আরেক দাদা এসে বলেছিল, “আমি তো দিল্লী চলে যাচ্ছি। আমার তিনটে ছাত্রকে পড়াবি?” সুকন্যা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বক্তৃতা না হয় সে ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই করে আসছে নানান দিবসে, নানান জয়ন্তীতে। তাই বলে ছাত্র পড়ানো? সে তো আগে কখনও পড়ায়নি কাউকে। এদিকে পড়ালে যে কাফকা, কামু, লিপস্টিক সব তার, সে সম্ভাবনাটাও সে ফেলতে পারছিল না। সমাধান করে দিলেন এক মাস্টারমশাই। তিনি যাচ্ছিলেন কোথাও। যেতে যেতে সুকন্যার সাথে অন্য ছেলেটির কথোপকথন শুনে ফেলেছিলেন। সুকন্যাকে বলেছিলেন, “আমিও তো একদিন প্রথমবার পড়িয়েছিলাম।”

এরপর সুকন্যার জীবনে অনেক কিছু প্রথমবার ঘটতে লাগল। বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, পিকনিকে যাওয়া, কানে ইয়ারফোন গোঁজা আর ওয়াকম্যানে গান শোনা, ইন্টারনেট সার্ফ করা। এই সময়টায় তার নিজেকে মোজার মতো মনে হত। প্রত্যেকটা প্রথমবারের পর মনে হত কেউ যেন মোজাটাকে উলটে দিল একবার। এই সব ওলোটপালোটের মধ্যে সুকন্যার কিছু চ্যালা জুটেছিল। সুকন্যা তখন বেশ ‘সুকন্যাদি’ হয়ে উঠেছিল।

তবু মাঝে মধ্যে পরীক্ষা ঘনিয়ে উঠলেই তার জীবনটা কেমন যেন “দুচ্ছাই, ভাল্লাগে না” হয়ে যেত। আর পরীক্ষা কাটিয়ে উঠলেই তাকে পেয়ে বসত নতুন কিছু করার উশখুশানি। এইসব উশখুশানির সময় চ্যালাদের নিয়ে সুকন্যা কিছু একটা করার চেষ্টা করত। যেমন কলেজের সামনের ফুটপাথবাসী ছাত্রদের পড়ানো; পার্ক সাফ করা, সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গাছ লাগানো; গ্রামে গিয়ে ছাত্রদের জন্য ক্যুইজ প্রতিযোগিতা করা।

একসময় কলেজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটিতে দুশো জনের ক্লাস। নিজের নিজের দলের বাইরে কেউ কাউকে চিনতে চাইত না। সুকন্যার চালু জীবনটা হঠাৎ যেন অচল হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ফাঁক পেলেই সে তখন কলেজে চলে যেত। চ্যালাদের সাথে আড্ডা মেরে বা কাজকম্ম করে বাড়ি ফিরে যেত। ছাত্র ধর্মঘটের দিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হত না। কিন্তু কলেজে মাস্টারমশাইরা নিজেরা গেটে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের কলেজে ঢুকিয়ে নিতেন। সেদিনগুলোতে সকাল সকাল সুকন্যা গিয়ে কলেজে ঢুকে পড়ত। তারপর কোনও মাস্টারমশাইয়ের ঘরে বসে, পড়ে, পড়া বুঝে বা পড়িয়ে কাটিয়ে দিত সারাদিন।

এরকম একটা ছাত্র ধর্মঘটের দিন কলেজের পাঁচিলে একসার লোক নিজেদের জলমুক্ত করছিল। দেখে সুকন্যার কিছু করার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেদিন সপারিষদ দরবারে সে ঠিক করেছিল যে, মিউয়েরেটিক অ্যাসিড, ফিনাইল আর ঝাড়ু কেনা হবে। তারপর মূত্রমুক্ত করা হবে দেওয়াল। ফের যাকে দেখা যাবে পরিষ্কার দেওয়ালের ধারে নিজেকে জলমুক্ত করতে, তার থেকে ফিনাইল, অ্যাসিড আর ঝাড়ুর খরচ তুলে নেওয়া হবে, আর তাকে দিয়েই দেওয়াল পরিষ্কার করানো হবে।

সেদিনই কলেজ ছুটির পরে দেওয়াল পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধের সময়টা বয়েজ হস্টেলের ছেলেরা পাহারায় ছিল। যে কজনকে ওরা দাঁড়াতে দেখেছিল দেওয়ালের সামনে তাদের ওরা মানা করেছিল। কোনও কারণে লোকগুলো মানা শুনেছিল। পরের দিন সন্ধে থেকে গভীর রাত অবধি কলেজের দারোয়ান বলরামদা নজর রাখতে লাগল। আর ভোর থেকে কলেজ শুরু হওয়া অবধি বয়েজ হস্টেলের বাহাদুরদা। একদিন সকালে একটা লোক বাহাদুরদাকে বোঝাতে গিয়েছিল, “মানুষের আড়াল লাগে। তাই তো দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় লোকে।” সে লোকটাকে বাহাদুরদা একটাকা দিয়ে সুলভ শৌচাগার দেখিয়ে দিয়েছিল। এরকম দয়াতে ছাত্ররা বিরক্ত হয়েছিল। টাকা দিয়ে শৌচাগারে পাঠালে যে দেওয়ালের আড়াল নিত না, সেও নেবে। টাকাটা রোজগার হবে আর অন্য কোনও দেওয়ালের আড়ালে কাজটা সেরে নেবে। তাই দফায় দফায় ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ হতে লাগল। দেওয়াল বাঁচানোর প্রকরণ নিয়ে।

একদিন দুপুরে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে একটা লোক “কেয়া করে, গরীব হৈ?” বলে ডুকরে উঠেছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার শারীরিক আবশ্যিকতার সাথে ধনী-গরিবের শ্রেণীবৈষম্যের সম্পর্ক বোঝেনি। তাই সে লোকটাকে দিয়ে দেওয়াল তো সাফ করিয়েই ছিল, আর লোকটা সাফাইয়ের খরচ দিতে পারেনি বলে একটা কাগজে নানা ভাষায় “সাবধান! আমি দেওয়ালে হিসি করি” লিখে কাগজটা লোকটার জামার পিঠে আঠা দিয়ে এঁটে দিয়েছিল। একটা লোক থার্ড ইয়ারের তিনটে ছেলেমেয়েকে, “হুজ্জুতি করছ কেন? ফুচকা খাবে? পয়সা চাই?” বলে তাদের হাতে তিরিশ টাকা গুঁজে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে মুক্ত হতে চেয়েছিল। তারা টাকা তো নিয়েই ছিল। তার ওপর লোকটার জামাতেও কাগজ সেঁটে দিয়েছিল, “আমার টাকা সস্তা তো, তাই যেচে ঘুষ দিই।”

==============

সংহিতা মুখোপাধ্যায়ের ‘গুচ্ছ খোরাক’ বই থেকে ‘সুকন্য বৃত্তান্ত’ গল্পটির অংশবিশেষ।

প্রাপ্তিস্থান — https://goo.gl/wYkNMj

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>