Blog

তেঁতুলপাতার গল্প-সৈকত মুখোপাধ্যায়

বই — তেঁতুলপাতার গল্প | লেখক — সৈকত মুখোপাধ্যায় | প্রিন্ট ভার্সান অর্ডারের লিংক — https://goo.gl/GGxQiy
ই-বুক অর্ডারের লিংক — https://goo.gl/WHqK1w
=============

লেডিস সাইকেল

মনে আছে, ক্লাস নাইনে উঠে কিছুতেই ফুটবল-টুর্নামেন্টে নাম দিলাম না, শুধু অত লোকের সামনে হাফপ্যান্ট পরতে হবে — এই লজ্জায়। লজ্জা… কারণ রোগা রোগা পা দুটোতে হঠাৎ এত লোম, লজ্জা… কারণ গলার স্বর ভাঙা, লজ্জা… কারণ মেয়েরা হঠাৎই এত রহস্যময়ী। ত্রাসে, আতঙ্কে, মনখারাপে আমার চোখের নীচে কালো রেখা ফুটে উঠল, ঠোঁটের ওপর নীল।
মানিক স্যারের বাড়ি অঙ্কের টিউশনে যেতাম। মানিক স্যার তাঁর নিজের মেয়ে ঝুপুকে আর আমাকে অঙ্ক কষতে দিয়ে বাজার যেতেন। তখনও ভালো করে সকাল হত না।
ঝুপুদি তখন গার্লস স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে। সারাক্ষণ একটা লেডিস সাইকেলে চষে ফেলছে আমাদের মফস্বল শহর। সারা শীতকাল, যেখানে যত ক্লাবের স্পোর্টস হত, সেখানে দৌড়ের ইভেন্টগুলোতে ঝুপুদি ফার্স্ট হবেই। মানিক স্যারের সেই বাইরের ঘরে একটা কাঠের আলমারির মাথায় ঝুপুদির প্রাইজে পাওয়া প্লাস্টিকের জগ, ওয়াটার বটল এইসব ডাঁই করে রাখা থাকত।
ঝুপুদি আরও অনেক ভোরে বান্ধবসংঘের মাঠে প্র্যাকটিশ সেরে ট্রাকস্যুট পরেই অঙ্ক কষতে বসত। আমি আড়চোখে দেখতাম ঝুপুদির কাঠ কাঠ চেহারা, ছেলেদের মতন ছোট করে ছাঁটা চুল, হাড় ঠেলে ওঠা মুখটা আমারই মতন বিধ্বস্ত, এমনকী ট্রাকস্যুট উঠে গেলে, ফরসা পায়ের গোছে আমারই মতন কড়া লোম। তবু ঝুপুদি কোথায় যেন ভীষণ আলাদা। অতক্ষণ ঝুপুদির সঙ্গে একলা ঘরে বসে থাকতে থাকতে আমার গলা আঠা হয়ে যেত। মানিকস্যার এলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।
তারপর একদিন মানিকবাবু বাজার যাওয়ার সময় বললেন, “ঝুপুর জ্বর হয়েছে, বুঝলি। তুই আজ একা।”
ঘরের একদিকে নোনা ওঠা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা থাকত ঝুপুদির সাইকেলটা। ওটা আমাকে কেন যে অমন টানত, বুঝতে পারতাম না। আজ একা থাকার সুযোগে, আমি উঠে গিয়ে সাইকেলটা ভালো করে দেখলাম। একদম আমার সাইকেলটার মতনই, কালো রঙটা এখানে ওখানে চটে গেছে; যেন ব্রণ খুঁটে ফেলেছে ভুলে। টায়ারে ভোরের মাঠের কাদা আর ঘাসের কুচি জমে আছে। ঠিক মনে হচ্ছে লোম গজিয়েছে সাইকেলের পায়ে। আমি হাত বোলাতে লাগলাম সাইকেলটার গায়ে। ‘লেডিজ সাইকেল’ — এই নামটাই আমাকে প্ররোচিত করছিল খুঁজে বার করতে, কেন লেডিস? কোথায় লেডিস?
আমি ছোট, বর্তুল বেলের ওপর থেকে হাত নামিয়ে আনলাম চামড়ার গন্ধওলা সিটে। চেন, প্যাডেল, স্ট্যান্ড, কেরিয়ার সবই তো এক! সাতসকালের আবছা আলোয় সাইকেলটা যেন আড়চোখে আমার ভ্যাবলা মুখ দেখে মজা পাচ্ছিল, যেমন মনে হয় ঝুপুদির চোখে চোখ পড়ে গেলে। হঠাৎই আমার হাত চামড়ার সিটের সরু কোমর থেকে খসে অতলে হারিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখলাম — সামনের রডটা নেই। ওটাই তাহলে তফাত!

– চাপবি?
ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম পর্দা সরিয়ে ঝুপুদি ঘরে ঢুকছে। জ্বরে তার মুখ থমথম করছে।
– লোভ লাগছে? চাপবি?
আবারও জিজ্ঞেস করল ঝুপুদি।

পরের বছর ফুটবল টুর্নামেন্টে নাম দিয়েছিলাম। ততদিনে আমার লজ্জা ভেঙে গেছে।

=============

বই — তেঁতুলপাতার গল্প
লেখক — সৈকত মুখোপাধ্যায়
প্রিন্ট ভার্সান অর্ডারের লিংক — https://goo.gl/GGxQiy
ই-বুক অর্ডারের লিংক — https://goo.gl/WHqK1w

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>