দশটি বসন্তকাল। কত দীর্ঘ সময়! তাদের যৌথ গুহাটির সামনে সে পা দুটি ভাঁজ করে বসেছিল। জায়গাটি নীরব। প্রথম বসন্তের বাতাসে শীতের মৃদু কামড়। সময় তার ওপরে বিশেষ ছায়া ফেলতে পারেনি। সেই আগেরই মতো সতেজ, সুন্দর রয়ে গেছে ইবা।
অথচ তালাই তো আর সুন্দর নেই। তাকে দেখলে বৃদ্ধা মনে হয়। তার চামড়ায় বয়সের কুঞ্চন। তার পেটটি সর্বদাই উঁচু হয়ে থাকে কোনও এক অজ্ঞাত রোগের প্রকোপে। দশ বছরে আটটি সন্তান হলে এইরকমই হয়। মনে মনে নিজের সঙ্গে তালাইয়ের শরীরের তুলনা করে একটা বিকৃত আনন্দ হচ্ছিল ইবার। অথচ, হৃদয়ের গভীরে সে তালাইকে হিংসা করে। তীব্র, বিষময় ঈর্ষা! তালাইয়ের দু’দুটি ছেলের পিতা তার ঈশির। অথচ এতদিনেও সে ইবাকে একটিও সন্তান দিতে পারল না। মাত্রই কিছুদিন আগে তালাই আর তার আট সন্তানের জন্য ইবাকে তার ঝিলের পাড়ের গুহাটি ছেড়ে দিতে হয়েছে। গুহাটি প্রশস্ত ও আরামদায়ক। অতএব তেমন বাসস্থান তালাইয়েরই প্রাপ্য। সন্তানবতী মায়ের আদর সকল গোষ্ঠীতেই বেশি। ইবার ভাগ্যে এখন জুটেছে পাহাড়ের মাথার শীতল অঞ্চলের এই ছোট্ট গুহাটি। বন্ধ্যা মেয়ের এর বেশি কী-ই বা আর প্রাপ্য হতে পারে! তাতে অবশ্য ইবার কোনও দুঃখ নেই। স্বেচ্ছায়, বিনা প্রতিবাদে সে ছেড়ে দিয়েছে তার আরামপ্রদ গুহাটিকে। গোষ্ঠীজীবনের এ-ই তো নিয়ম।
ইবার অবশ্য একটি বিরল সৌভাগ্য আছে। গত দশ বছরে তার প্রতি ঈশিরের আনুগত্য ও ভালোবাসাতে ঘাটতি পড়েনি কোনও। তাদের জুড়িটি এখনও গোষ্ঠীর অন্য মেয়েদের ঈর্ষার বস্তু। শুধু… একটি সন্তান… নিজের প্রাণ দিতে পারে ইবা একটি সন্তানের জন্য। তবু ঈশির কেন তাকে সেটুকু দিতে পারে না! কোন অভিশাপে!
নিচের থেকে দ্রুত পদক্ষেপের শব্দে চমক ভাঙল ইবার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দুটি শক্তিশালী বাহু এসে ঘিরে ধরল তাকে। তার দেহে অরণ্য ও চন্দ্রালোকের সুগন্ধ। ইবা ঈশিরের কোল ঘেঁষে এল। তার চোখের জল ধুইয়ে দিচ্ছিল ঈশিরের বুক। কিছু পরে নিজেকে সংযত করে সরে বসল সে। তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, “বনের মধ্যে বৃক্ষদেবতার কাছে যাব আমি।”
ঈশিরের গলাটা যেন কেঁপে উঠল একবার — “কিন্তু… তিনি যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর অধীশ্বর! যে প্রাণী তাঁর কাছে যায় তারই যে মৃত্যু অবধারিত! বৃদ্ধেরা কি আমাদের বারে বারে সাবধান করে দেন না? তাঁর কাছে যেতে নেই। খেতে নেই তাঁর ফল!”
“কিন্তু ঈশির… ঈশির… তিনিই যে সবচেয়ে শক্তিমান দেবতা! যাঁর নামে স্বয়ং গোষ্ঠীপতিও ভীত হয়ে নতজানু হন, তিনিই কি প্রকৃত ঈশ্বর নন? যিনি অরণ্যের সবচেয়ে শক্তিমান জীবকে মুহূর্তে হত্যা করতে পারেন, ইচ্ছা করলে কি তিনি সামান্য একটি জীবন উপহার দিতে পারবেন না আমার দেহের ভেতরে? ঈশির আমায় সন্তান দেয়নি। এবারে হয় সেই সেই দেবতা আমাকে একটি সন্তান দেবেন, অথবা দেবেন চোখের পলকে মৃত্যু। এই দুটির মধ্যে একটি ছাড়া আর আমার কিছু প্রয়োজন নেই ঈশির।”
ঈশিরের মনের ভিতরটি ভয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু ইবাকে সে জানে। জগতের কোনও ভয়, কোনও প্রলোভনই আর তাকে থামাতে পারবে না এখন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, “ঠিক আছে। তবে আজ রাতে নয়। কাল। সূর্যোদয়ের পর।”
অরণ্যের কেন্দ্রস্থলে, নিষিদ্ধ গাছটি নদীর পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকে। মাত্রই দশ বছর বয়স তার। তবু, এই বয়সেই উচ্চতায় সে অরণ্যের বহু গাছকেই ছাড়িয়ে গেছে। এখন তার ফল ধরবার ঋতু। লালে হলুদে মেশানো উজ্জ্বল ফলগুলি যেন আলো করে রেখেছে গাছটিকে। তার নিচের ডালগুলি ফলভারে মাটিকে ছুঁয়ে থাকে প্রায়।
একটি হাতি পরিবার সকালের দিকে নদীতে স্নান করতে এসেছিল। কিছু আগে তারা ফিরে গেছে। দলের সবচেয়ে ছোট সদস্যটি একটি ফল শুঁড়ে ধরে পরীক্ষা করতে গিয়েছিল। তার মা তাকে মাথা দিয়ে ধাক্কা মেরে মেরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ফের। সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত ওই গাছটিকে তারা সকলেই চেনে। গোটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র হাড়গোড় ও পচাগলা মৃতদেহ ওই মৃত্যুদুতের শক্তির সাক্ষ্য বহন করে।
ঝোপঝাড় ভাঙবার মৃদু একটা শব্দ উঠল কাছেই কোথাও। প্রথমে একটি শুঁড়, তারপর তার পেছন পেছন সম্পূর্ণ শরীরটাই এবারে বার হয়ে এল বাইরে। হস্তীশিশুটি ফের ফিরে এসেছে। লোভেরই জয় হয়েছে শেষে। মা নেই কাছাকাছি। নিঃশব্দ পায়ে সে এবারে এগিয়ে এল গাছটির কাছে। শুঁড়ে তুলে পরখ করে নিল একটি ফল। তারপর সেটিকে মুখে পুরে দিল। অপূর্ব স্বাদ। এবারে আরও একটা…
পেটভর্তি করে ফল খাবার পর একটু নেশার মতোই হয়ে গিয়েছিল তার। ফলগুলোতে সামান্য মাদক ভাব আছে। শিশুটি এইবারে জলের ধারে রৌদ্রে গিয়ে বসল। তারপর একটি আরামের শব্দ করে আলস্যে শরীর এলিয়ে দিল মাটিতে। তার চোখে ঘুম আসছে।
পেটের ভেতর ফলের কোষগুলি দ্রুত ফেটে পড়ছিল। লক্ষ লক্ষ ভাইরাল ডি এন এ তন্তু তাদের নিউক্লিয়াসের বাসা ছেড়ে বার হয়ে আসছিল। পাচকরস তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। অর্ধপাচিত খাদ্যের সঙ্গে মিশে তারা এগিয়ে গেল অন্ত্রের দিকে। তারপর সেখান থেকে পাচিত খাদ্যরসের সঙ্গে রক্তস্রোতে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল আক্রমণকারীরা।
হস্তীশিশুটি নরম রৌদ্রে পিঠ দিয়ে ঘুমায়। ফলের মাদকরস তার নার্ভতন্ত্রকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর ঠিক সেই সময় তার দেহের প্রতিটি কোষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল এক-একটি আগন্তুক ডি এন এ তন্তু। আমূল বদল আনছিল কোষের গঠনে। কোষগুলি বদলে যাচ্ছিল প্রভুজীবের দেহকোষে। বদলাল না শুধু দেহের গঠন ও স্মৃতি। সেটা পরবর্তী প্রজন্মের সৃষ্টির আগে সম্ভবও নয়।
পড়ন্ত রোডের আলোয় ঘুম ভাঙল শিশুটির। মাদকের নেশা কেটে গেছে। সেই আচ্ছন্নতার মধ্যেই নিজের অগোচরে সে নিজেও বদলে গেছে ভেতর থেকে। চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল সে একবার। আর তার পরেই টলে উঠে আছড়ে পড়ল মাটির বুকে। সদ্য পরিবর্তিত, মানবকোষের মতো করে গড়ে তোলা দেহকোষগুলি একটা হাতির দেহকাঠামোকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম নয়। সমস্ত দেহ ও চেতনাটাই তার একটা চূড়ান্ত বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছে। একে একে তার শরীরের প্রধান যন্ত্রগুলি অচল হয়ে আসে। তারপর, এক তীব্র যন্ত্রণাদায়ক সময়ের পরে তার হৃৎপিণ্ডটি থেমে গেল।
আছড়ে পড়া মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে দেখল একবার প্রজাপতিটি। আরও একটি ব্যর্থ পরীক্ষা। আরও একটি মৃত্যু।
=================
‘নিষিদ্ধ ফল’ গল্পের অংশবিশেষ।
সংকলন — ঈশ্বরী
লেখক — দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য