Blog

শাফুং-সুবর্ণা রায়

মুঙ্কিদিদি চলে যাচ্ছে। বাড়ি। দু-দিন ছিল মোটে।
পাঁচতলার ওপর থেকে নিচে দাঁড়ানো গাড়িটা দেখতে পাচ্ছে ঋজু, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে।
বাবা আর মেসো ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে গেছে।
মা, মাসি এখনও বসার ঘরে। জরুরি কথা কিছু বলে নিচ্ছে।
মুঙ্কিদিদি একবার বারান্দায় আসছে, ঋজুকে জড়িয়ে আদর করছে, আবার ঘরে গিয়ে কিছু করে আসছে।
অনর্গল বকতে পারে মুঙ্কিদিদি। ঋজুর কী যে ভালো লাগে!
এই দু-দিন কত গল্প শুনিয়েছে! রূপকথার গল্প বেশি পছন্দ ঋজুর। যেসব গল্পে দুষ্টু লোকেরা শেষে খুব শাস্তি পায়, হারানো শিশু ফিরে পায় মা-র কোল, মরুভূমির দেশে মন্ত্রবলে বসন্ত এসে পড়ে — সেইসব গল্প মুঙ্কিদিদি এক নিশ্বাসে বলে যায়। ঋজু গোগ্রাসে গেলে।
এবার আবার সব চুপচাপ হয়ে যাবে। ঋজুর মন খারাপ করছে। কান্না পাচ্ছে।
কিচমিচ! কিচমিচ!
বারান্দার গ্রিলে একটা কমলা রঙের পাখি। ঋজু নাম জানে না। আগে দেখেও নি।
– মনের বোঝা সারায় যে জন, তেমন ওঝা নেই!
পাখিটা হুবহু মুঙ্কিদিদির গলায় গান গাইছে। দু-লাইন গেয়ে ঋজুর দিকে চেয়ে থমকে গেল।
– চোখের জলে মুক্তো হয়। মুক্তো থাকে সাগরের নিচে। তুমি তো আবার সাঁতার জানো না। তাই, কাঁদবেও না। বুঝলে?
পাখিটা ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়েছে।
কিন্তু এ কী! একটা মস্ত বড় বাজপাখি প্রচণ্ড জোরে নেমে আসছে আকাশ থেকে এইদিকেই!
পাখিটা খেয়াল করছে না। কিছু বোঝার আগেই ছোঁ মেরে ওকে তুলে নিয়ে গেল বাজ।
ঋজু মনে মনে কাকুতি করল ভগবানের কাছে, মিনতি করল আল্লার কাছে। মা যেমন মাঝেমাঝে করে। পাখিটাকে বাঁচাও কেউ!
গোল বেধে গেছে আকাশে। সাদা আর কালো মেঘের মধ্যে ভীষণ মারপিট হচ্ছে। কালোমেঘের দল বাজটাকে লুকিয়ে নিতে চাইছে, সাদারা পাখিটাকে।
মেঘের ঘষায় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতে ঋজু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেঘেদের অনেক ওপরে এক বিশাল রাজপ্রাসাদ। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট রাজকুমার। ঝুঁকে পড়ে ডাকছে পাখিকে, আয়! আয়!
কমলা পাখি আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে বাজের সঙ্গে। ধারালো নখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। রক্ত পড়ছে। হাওয়ায় উড়ছে পালক।
উপরের দিকে দেখছে কমলা পাখি। বাসায় ফিরতে চায় সে। রাজকুমারের কাছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।
মেঘেদের যুদ্ধ তুমুল চলছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বারবার।
এর মধ্যেই হঠাৎ করে বাজের পা থেকে ফসকে গেল কমলা পাখি। রাজকুমার আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু পাখি উড়তে পারছে না! ডানা ভেঙে গেছে একদিকে। নিচের দিকে পড়ছে পাখি।
কাছে এগিয়ে আসছে লম্বা বাড়ি, গাছ, কংক্রিটের রাজপথ। এগিয়ে আসছে মৃত্যু।

না! ধরে ফেলেছে ঋজু! পাখি বেঁচে গেছে। ঋজুর দু-হাতের নরম তালুতে জীবন ফিরে পেয়েছে ছোট্ট মিষ্টি পাখিটা।

মুঙ্কির চিৎকারে দৌড়ে এসেছে, মা, মাসি। মেসো আর বাবা নিচ থেকে দেখতে পাচ্ছে, বারান্দার গ্রিল থেকে বেরিয়ে আছে দুটো কাঁপা কাঁপা হাত।
হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ঋজু। বিজয়ীর হাসি মুখে। হাতের মুঠোয় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা।

===================

গল্পের নাম ‘কমলার গান’। কলমের নাম সুবর্ণা রায়।

সুবর্ণা রায় অণুগল্প লিখছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। এই বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘শাফুং’। সুমিত রায়ের অলংকরণ আর প্রচ্ছদে মোড়া বইটি সৃষ্টিসুখ-এর স্টলে (442) পাওয়া যাবে কলকাতা বইমেলা ২০১৮-য়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>