চেন্নাই বইমেলার প্রথম দিন। স্বাভাবিকভাবেই পাঠক বেশী ক্রেতা কম। তাও চাহিদা বেশী সুনীল-সঞ্জীব-শীর্ষেন্দু-সমরেশ দের। একটু ফুরসৎ পেয়ে এক ষাটোর্দ্ধ ভদ্রলোক এলেন সামনে। এদিক ওদিক নজর চালিয়ে, কিছুটা হতাশ গলাতেই বললেন, “নাটকের কোনো বই নেই?”
নাটকের বই! এই উইকিপিডিয়া-গুগল প্রজন্ম কি আদৌ জানে, যে নাটকের বই হয়! চটি বইতে সিরাজদ্দৌল্লা, চন্দ্রগুপ্ত ইত্যাদি ঐতিহাসিক নাটক অথবা গরুর গাড়ির হেডলাইট-এর মতো কৌতুকি, সোনাইদিঘি-র মতো সামাজিক যাত্রাপালা… তার পাতলা কাগজে ছোট ছোট হরফে কীভাবে জড়িয়ে আছে বাঙ্গালিদের বিনোদন ও সংস্কৃতির এক অধ্যায়… এর খোঁজ আর কেউ রাখবে কি কোনোদিন!
নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই বললাম, “নাট্যকার শ্রী বিধায়ক ভট্টাচার্যের ওপর লেখা একটা বই আছে। তাতে তাঁর লেখা একটি নাটকও পাবেন, আর পাবেন তাঁর সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। যাঁরা নিজেদের গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন নাটককে, তাঁদের জীবনীটাই তো একটা নাটক হয়ে যায়, তাই না?”
ভদ্রলোক একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “খাঁটি কথা বলেছেন। এটা আমারও বিশ্বাস। কই, দেখি বইটা!”
ভরসা পেয়ে হাতে তুলে দিলাম শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা “নাট্যে উপেক্ষিত” বইটি। এগিয়ে দিলাম একটা চেয়ার। অল্প হেসে চেয়ারে বসে বইটার একেবারে ভূমিকা থেকেই পড়তে আরম্ভ করলেন। আর, মুহুর্তে ডুবে গেলেন।
শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা সকলেই ওনার বৈঠকী লেখনশৈলীর বিশেষ ভক্ত। এতটুকুও পাণ্ডিত্য না জাহির করে তিনি অনেক তথ্য আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে উপস্থাপন করেন, প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেন গূঢ় তত্ত্ব। ওনার “দোতলা বাস, এবং” ও “চাপড়ঘন্ট” পড়া থাকলে বুঝবেন যে কতো বৈচিত্র ওনার কলমে। এখানে উনি অনেকটা স্মৃতিচারণের ভঙ্গীতে নাট্যকার, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ শ্রী বগলারঞ্জন (কবিগুরু পরে যাঁর নাম দিয়েছিলেন বিধায়ক) ভট্টাচার্য-র জীবনের নানা অধ্যায় তুলে ধরেছেন। কিন্তু, হঠাত নাটক কেন!
লেখকের ভাষাতেই বলি, “কথায় আছে, পুজোর আচারবিধি বা মন্ত্র না জানলেও ভক্তি ভরে দেবতার পায়ে ফুল রাখলেও সেই পুজো সিদ্ধ হয়। সেই ভরসাতেই লিখতে বসা আমার কৈশোর বয়সের এক অন্য ভুবনের স্রষ্টাকে।”
একেবারে পুজোর মতোই আচমন, পুষ্পশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, সংকল্প, প্রধানপূজা, এইভাবেই এগিয়েছেন তিনি। বইটি লেখার ইতিহাস, তথ্যসংগ্রহের ভূমিকা থেকে আরম্ভ করে চলে এসেছেন নাট্যকারের জীবনীতে। কোনো ব্যক্তিগত মন্তব্য বা টিপ্পনি নয়, গল্পকারের মতো বলেছেন বিধায়কবাবুর জীবনের নানা ওঠাপড়া, ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প। বিভিন্ন তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন, সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে কিছু বিরল ছবি। গল্পের ছলে প্রায় বিস্মৃত একটা যুগকেই যেন তুলে ধরেছেন তিনি।
বইটির দ্বিতীয় ভাগে “অচেনা বিধায়ক” অংশে রয়েছে বিধায়কবাবুর লেখা একটি রহস্য কাহিনী, দুটি প্রবন্ধ এবং একটি সম্পূর্ণ নাটকের সংকলন। সব মিলিয়ে সত্যিই এটি একটি…
“…সংগ্রহ করে রাখবার মতো বই!” মনের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন ভদ্রলোক। “অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে! চেন্নাইতে বসে এমন একটি বই হাতে তুলে দিলেন…!”
বইটির নামে বিল প্রস্তুত করতে করতে ভাবছিলাম, এই ধন্যবাদটা আসলে কার প্রাপ্য, রামকৃষ্ণবাবুর, বিধায়কবাবুর, সৃষ্টিসুখের, নাকি নাট্যপ্রিয়, সাহিত্যপ্রেমী সমস্ত বাঙ্গালিরই!
— প্রকল্প ভট্টাচার্য
Be the first to review “নাট্যে উপেক্ষিত”