আমি যখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি, তখন জন্মদিনে আমায় কেউ একটা বই উপহার দেন –– আবদুল আযীয আল আমানের লেখা ‘ছোটদের মহানবী’। ছোটদের মতো করে লেখা হজরত মহম্মদ (সঃ)-এর জীবনীধর্মী একটা বই। বইটা পড়ার আগে আমার ধারণাই ছিল না মহানবী আসলে কে, কেউ আমায় এর আগে বলেও দেননি। কিন্তু লেখক বইটা এতটাই দরদ দিয়ে মায়াবী ভাষায় লিখেছিলেন, আমি প্রথমবার পড়ার পর প্রায়ই বইটার নানা অংশ প্রায়ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তাম।
তৎকালীন আরবে কোরায়েশ বংশের এক শিশুর জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে তাঁর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘটনা এত সহজে আর কেউ কোনওদিনও বুঝিয়ে বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। নবী হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগেই কৈশোর-যৌবনে সেই মানুষটির সততা, নিয়মনিষ্ঠা এবং সারল্য সবার কাছে তাঁকে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। সত্যভাষণের জন্যে তাঁকে বলা হত ‘আল আমিন’। চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে নবী হিসাবে তাঁর একেশ্বরবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল পৌত্তলিক ধর্মালম্বীদের সঙ্গে সংঘাত। অত্যাচার শুরু হল তাঁর ওপর। বাদ গেলেন না তাঁর অনুগামীরাও। প্রাণ বাঁচাতে এক সময় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে তিনি পাড়ি দিলেন মদীনার পথে। মদীনার মুসলমানরা এরপর মক্কার কোরায়েশদের সঙ্গে প্রাণরক্ষার তাগিদে একাধিক লড়াইয়ে জড়িয়েছেন। রক্ত ঝরেছে দুপক্ষেই। কিন্তু এক সময় তাঁরই জয় হল। বিজয়ী হজরত মহম্মদ (সঃ) ফিরে এলেন মক্কায়।
এবং আমার কাছে বইটির সবথেকে আকর্ষণীয় জায়গা কিন্তু এটাই ছিল। যারা তাঁর ওপর এক সময় অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে তঞ্চকতার আশ্রয় নিয়ে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল তাঁর একাধিক অন্তরঙ্গ বন্ধুকে –– তাঁদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিলেন। এমনকী কিছু মানুষ নিজেদের ক্ষমার অযোগ্য ভেবে লুকিয়ে ছিলেন, তাঁদের তিনি বুকে টেনে নিলেন। নিজের জীবনকে দৃষ্টান্ত হিসাবে সামনে রেখে তিনি ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর জীবনীর নানা পাঠ, নানা বিশ্লেষণ পড়েছি, অনেক সমালোচনা দেখেছি, বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। কিন্তু আমার কাছে হজরত মহম্মদ (সঃ) মানুষ হিসাবে আবদুল আযীয আল আমানের বর্ণনার সেই মহানবী, যিনি নির্বিচারে সমস্ত শত্রুকে ক্ষমা করে দেন। যাঁর কাছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই ইসলামের মূলকথা।
ব্যক্তিগতভাবে আমার অন্তত মনে হয় না, তাঁকে কোনও কার্টুন চরিত্র হিসাবে আঁকলে বা তাঁকে ব্যঙ্গ-মজা করে কোনও ছড়া-কবিতা-গল্প লিখলে হজরত মহম্মদ (সঃ) নিজে বিচলিত হতেন। তাঁর জীবনচর্যা অন্তত সেই কথাই বলে। কিন্তু যারা ইসলাম ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবক, সমস্যা তাদের নিয়েই। তাদের বিশ্বাস নিয়ে না-পসন্দ যে কোনও মতই যদি অস্ত্রের আঘাতে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; তাহলে সবথেকে বেশি অসম্মান করা হয় সেই মানুষটাকে, যিনি সারাজীবন মানুষকে ক্ষমা আর শান্তির কথা শুনিয়ে এসেছেন। যে মানুষটা নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তায় তাঁর তৎকালীন শত্রুদের থেকেও সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতির প্রতি এর থেকে বড় অবিচার আর হয় না। ধর্মরক্ষার জন্যে কথায় কথায় খঞ্জর নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, আপামর মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টাটাই বোধ হয় হজরত মহম্মদ (সঃ)-এর প্রতি সবথেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য হতে পারত। আশা করি তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি (বিদ্যার্জনের জন্যে যদি সুদূর চিনেও যেতে হয়, যাও।) ধর্মনির্বিশেষে মানুষ মনে রেখেছেন।
আমি জানি, যারা ব্লগার খুন করে, তারা কোনওদিনই আমার এ ব্লগ পোস্ট পড়বে না। এও জানি, যারা এই খুনিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তারা আমার এই পোস্ট পড়েও নিজেদের স্বার্থের ওপরে মানবিকতাকে স্থান দেবে না। কিন্তু যে সরল বিশ্বাসে আমি ‘ছোটদের মহানবী’ এখনও ধারণ করে আছি; সেই তীব্র বিশ্বাসেই জানি, যে কোনও অত্যাচারীই যেমন দ্রুতগতিতে নিজের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, এদের জন্যেও একই পরিণাম অপেক্ষা করে আছে।
আসুন নজরুলের সেই কবিতাটা আরও একবার পড়ি।
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ
ক্ষমা করো হজরত।
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ
ক্ষমা করো হজরত।
বিলাস বিভব দলিয়াছ পায় ধুলিসম তুমি প্রভু
তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা নওয়াব কভু।
এই ধরণীর ধন সম্ভার, সকলের তাহে সম অধিকার।
তুমি বলেছিলে, ধরণীতে সবে সমান পুত্রবত।
ক্ষমা করো হজরত।
তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন্-ধর্মীর পূজা মন্দির, ভাঙতে আদেশ দাওনি, হে বীর,
আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনাকো পর-মত।
ক্ষমা করো হজরত।
তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি,
তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বানী,
মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা, সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা,
বেহেশত হতে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত।
ক্ষমা করো হজরত।
— রোহণ কুদ্দুস
Be the first to review “ছোটদের মহানাবী”