গল্পকার শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে মানুষ শৌভিকের সঙ্গে পরিচয় আমার আগে। ওর সহজ সরল আন্তরিক মনের স্পর্শ আমাকে যেমন চমকিত করেছিল, তেমনই মুগ্ধ হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সম্পূর্ণ অপরিচয়ের বেড়া ডিঙিয়ে শৌভিক কেমন আপনজন হয়ে উঠল দিনে দিনে। যদিও লেখালিখির সূত্রেই শৌভিকের সঙ্গে আমার পরিচয়, বন্ধুতা এবং অন্তরঙ্গতা। ও আমার গল্প ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার কথা মুখে নয়, রীতিমতো কাগজে কলমে প্রমাণ রেখেছে। এবার শৌভিক দাবি নিয়ে এসেছে ওর গল্পের বইয়ের ভূমিকা আমাকে লিখে দিতে হবে। এটা যে কী কঠিন কাজ, আমি আদৌ এর যোগ্য কিনা – শৌভিককে অনেক বলেও বোঝাতে পারলাম না। ছোট ভাই হিসাবে ওর আবদার, ওর জেদের কাছে হার মানতেই হল অবশেষে।
শৌভিক গল্প লেখে। বেশ কিছুদিন ধরে ওর গল্পের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। তবে খুব বেশি গল্প লেখে বলে মনে হয় না। যতটুকু লেখে, সেগুলো এক জায়গায় পড়ে মনে হয়েছে আমি যেন প্রাণের স্পর্শ পেলাম। যেমন পাই ওর ব্যবহারে, আচার-আচরণে। লেখা তো এক কথায় আবিষ্কার। লেখককে আবিষ্কারকের ভূমিকায় প্রবেশ করতেই হয়। এ তো সত্যি, জীবন কখনও সোজা সরলরেখায় চলে না। সময় যেমন ক্রমাগত বাঁক বদল করছে, জীবনকেও তেমনই বদলে যেতে হচ্ছে ক্রমাগত। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ঘটনা, কথালাপ, রাগ-রাগিণী – এসবের মধ্যেকার নির্যাসটুকু নিয়ে বোধের গবেষণাগারে ছেঁকে, নেড়েঘেঁটে জীবনের সারসত্য কী, সেটা প্রকাশ করাই তার কাজ। বলতে দ্বিধা নেই যে, শৌভিক এই কাজটা করতে পেরেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ওর পরিবেশনে আছে হেমন্তের সকালে ঘাসের উপর শিশিরবিন্দুর মতো একটা তরতাজা অনুভূতি। চেতনায় আছে সময়কালিক স্পর্শ। নগর মানসিকতার ঠাসবুনোট ক্যানভাসে সাদা কালো রঙগুলিকে ধরিয়ে দেওয়ার এক আন্তরিক স্পর্শ আছে গল্পের ছত্রে ছত্রে। নিছক গল্প কাঠামোর আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে জীবনকে সোজা ও সরলরেখায় দেখা ও দেখানোর প্রয়াস, সেই সঙ্গে স্মার্ট গদ্যভাষা ও চরিত্রের বহিরঙ্গ রূপের পরিবর্তে আন্তর-রূপটিকে প্রকাশের প্রয়াস – এই হল শৌভিকের গল্প ভঙ্গিমার নিজস্বতা। সত্যি বলতে কী গল্পকে সে কখনও বুনে তোলে না, বরং গল্পই নিজেকে বুনিয়ে নেয় হাল ফ্যাশানের পোশাকের মতো। শৌভিকের দেখার চোখে কোনও ঠুলি নেই। সে গল্পকে দেখে খুব সোজাসুজি। তারপর আধুনিক প্রযুক্তিবিদের মতো নিজস্ব নির্মাণাগারে ফেলে আছড়ে-পিছড়ে যে ইমারত বানায়, তা দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। শৌভিক যেন বলতে চায় – দেখুন, এও জীবন। হ্যাঁ, এই জীবন আমাদেরও চেনা, যাওয়া আসার পথের ধারে এইসব মুখ ও মুখোশের মুখোমুখি তো আমরাও; শৌভিকের দেখায় উপলব্ধি করতে হয়, নাহ এদের এখনও চেনা বাকি, জানা বাকি। শৌভিকের গল্প-আঙ্গিকে এ এক ধরনের বিশিষ্টতা। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে তার সূচীমুখের মতো তীক্ষ্ণধার শব্দের প্রয়োগ, জটিলতাময় জীবনের গতিপথে গদ্যভাষাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে সহজ অথচ একটু বঙ্কিম ভঙ্গীতে দেখানোর স্টাইল, এসব তাকে অনেক অনেক দূর নিয়ে যাবে – এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শৌভিকের গল্পগুলি পড়তে পড়তে আমার রাগও হচ্ছে, শৌভিক এত কম লেখে কেন? যেখানে গল্পের নামে একধরনের দেখনদারি, জাগলারি চলছে, সেখানে ওর মতো অনায়াসলব্ধ দক্ষতার অধিকারী এক কুশলী গল্পকারের আরও একটু সক্রিয় হওয়া উচিত নয় কি?
শৌভিকের গল্প আমি চাইব পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছক। তারা বাঁকা চোখে দেখুক, সোজা মনে পড়ুক, ঝগড়া করুক, ভালোবাসুক। শৌভিকের গল্পই দাবি করছে এইসব।
অনিল ঘোষ