জীবনের রহস্য এই যে, তার রহস্য কখনও ফুরোয় না। পরতে পরতে সে এক অপূর্ব আলো-ছায়াময় সংকলন, যার কোনও ফিক্সড রেফারেন্স অন্তত মানুষের হাতে নেই। জীবন একই, তবে ঠিক একই রকম নয়। এহেন বৈচিত্রের কারণেই এ সংকলনের পাতায় পাতায় মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু কৌতূহল যদি অযাচিত হয়, যদি নগ্ন স্নানরতা শিকারের দেবী আর্টেমিসকে দেখে ফেলা যায়, তবে কী পরিণতি হতে পারে? সে গল্প কারও জানা, কারও নয়। কিন্তু ভুল যদি একবার হয়েই গিয়ে থাকে, মানুষ কি তবে অতীতে ফিরে তা পালটে দিতে পারে? টাইম ট্রাভেলের ধারণা তা-ই বলে বটে। তবে সেখানেও বসে আছে বাঘা বাঘা প্যারাডক্স। ধরুন, অতীতে গিয়ে আপনি আপনারই জন্মদাতা কিংবা জন্মদাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে বাঁধা পড়ে গেলেন, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? অর্থাৎ, মাল্টিভার্সের তত্ত্ব আবশ্যিকভাবেই এসে পড়ছে। আবার এহেন তাত্ত্বিক বিষয়ে সামান্য মাথাভার হলে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি দাদা-বৌদির বিরিয়ানিতে। কিংবা ধরুন এই যে বিয়ের মরশুম চলছে, এই যে এত মন্ত্র পড়ে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে হচ্ছে, এই বিবাহরীতি ঠিক কোন গোত্রের? ভেবে দেখেছি কি?
প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলেছি এই কারণেই যে হৃষিকেশ বাগচী তাঁর ‘মুখোমুখি’ বইটিকে সাজিয়ে তুলেছেন এরকমই বিষয় বৈচিত্রে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে মহম্মদ আলি পার্ক, বসিরহাট থেকে পেঙ্গুইন বাবাদের কষ্ট– নানা বিষয়ে সাবলীল গতায়াত তাঁর। তাত্ত্বিক কচকচি তিনিও পছন্দ করেন না। কিন্তু জীবনের পদে পদে এত বৈচিত্র, দীর্ঘায়ু সভ্যতার পরতে পরতে এত বিস্ময় জমে আছে যে, হৃষিকেশের অনুসন্ধিৎসু মন খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে। কৌতূহল নিরসন করতে তিনি বিস্তর পরিশ্রম করেছেন। আর শেষমেশ মন্থনের সম্পদটুকু তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে। সবার আমি ছাত্র– এই পঙক্তিকে আজও আমরা লালন করি। হৃষিকেশ যেন সেটিকেই নেড়েচেড়ে দেখেছেন একটু অন্যভাবে। এত বিষয়, এত জানার জিনিস রয়ে আছে যে ওই ছাত্রস্বভাবটি হারিয়ে ফেলাই বৃথা। তবে লেখকের মুনিশিয়ানা বোঝা যায় যখন তিনি বিষয়ের ভারে লেখনকে ভারাক্রান্ত করেন না। বরং প্রাঞ্জল গদ্যে সাবলীলতায় তরতরিয়ে পাঠক টেনে নিয়ে যান এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ে।
বই যখন শেষ হয়, তখন অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছে। যা না জানা হলে আসলে আমরা অসম্পূর্ণ থেকে যাই। এ আসলে জীবনেরই মুখোমুখি বসা। চিনে নেওয়া আমাদের অস্তিত্ব আর প্রতিবেশকে। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি যাঁরা নানা বিষয়ে আগ্রহী, তাঁরা নিশ্চিতই এ বইয়ের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।
Be the first to review “মুখোমুখি”