জীবন বয়ে চলে বহু স্রোতে, বহু গন্তব্যে। ওই যে মহিলা পিওনের কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছে নীল সালোয়ারের ভিতর আর টুপি হাতে তাকে ঠিক খুঁজে নেবে বলে মনস্থ করছে আমাদের যুবক প্রেমিকটি, ওই যে আত্মজার লাঞ্ছনা কল্পনা করে কেঁপে উঠছে মধ্যাহ্নের রোদ্দুর, ওই যে ‘ডিস্কো’ (পড়ুন প্রতিবন্ধী) ছেলের জন্মে দুখ-আনন্দের যুগপৎ স্রোত খেলা করে, কারণ এ ছেলেই তো সৌদি পুলিশের চোখ এড়িয়ে মক্কার হজযাত্রীদের থেকে ‘রোজগার’ করে আনলে ঘরে সুদিন আসবে, কিংবা ওই যে বস্তা ভরা লাশের ভিতর স্ত্রী সোনাইকে খুঁজে পেয়ে হাত থেকে লাইটার পড়ে যায় অনন্তর, অথবা যেভাবে অচেনা মৃতার সঙ্গে অপ্রাকৃতিক প্রেমে ঘরছাড়া হয় যুবক কিংবা বিগতযৌবনা গওহরজান যখন তাঁর কলিজা রুপোর পিকদানিখানা তুলে দেন তাঁরই পালিতা কন্যার হাতে, তখন কলিজা ছেঁড়া যে যন্ত্রণা– তার মধ্যেই ঝিকিয়ে ওঠে ওই অনুরক্ত জীবন, যা অহরহ চুমু খায় যন্ত্রণাকে। এ এমনই যন্ত্রণা অস্তিত্বে থেকে যা না পাওয়ার মতো যন্ত্রণা বোধ হয় আর নেই। যন্ত্রণা, তবু সে সর্বগ্রাসী। সে ঠিক আমাদের আঁচড়ে-কামড়ে বিক্ষত করবেই, অথচ সে জ্বালাটুকুই যেন প্রশান্তি হয়ে তোলা থাকবে রমণতৃপ্ত নববধূর অন্তর্বাসের অন্তরালে, যেভাবে সোনাই একদিন অনন্তকে বলেছিল, ‘যেন রাক্ষস একটা…’
এই রাক্ষস জীবনকেই কাহিনিতে বেঁধেছেন কথাকার ইন্দ্রনীল বক্সী। ডিটেলিংয়ের চালচিত্রের উপরই তিনি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন তাঁর কাহিনির। আর সেই সূত্রে কাহিনির অতিরেকে ধরা পড়ে যায় সময়, তার গতিবদল। ইন্দ্রনীলের গদ্য, কাহিনির চলন মনে করিয়ে দেয় বাংলা ছোটগল্পে বিমল কর কিংবা মতি নন্দীর নির্দেশিত পথটিকে। সময় রাক্ষস ঠিকই, তবু তাকেই মমতায় বেঁধেছেন কথাকার। কিন্তু তাঁর পরিক্রমা মায়াবী নয়। সেখানে লাশ পোড়া গন্ধ ছোটে, সেখানে ডিও-র মিষ্টি গন্ধ ভেঙে দেয় সুখের শান্তিনিকেতন। এমনই বিপ্রতীপ, এমনই জীবনের অনুরাগ ও যন্ত্রণার সহাবস্থান তাঁর গল্পে।
Be the first to review “রাক্ষস”