ভোর না হতেই স্নান সেরে তৈরি কিশোরটি। বন্ধু তখন উদাত্ত স্বরে আবৃত্তি করছে, রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে’। আর, মন্ত্রমুগদ্ধের মতো শুনছে কিশোরটি। কতই আর বয়স! স্কুল ফাইনাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার থেকেও জরুরি ছিল দলের তথা দেশের কাজে যোগ দেওয়া। যে স্বপ্ন, যে আগুনের অঙ্গীকার, কিশোরটি আর তাঁর বন্ধুরা বুকে ধারণ করেছিলেন, তারই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাসন্ন। আর একটু পরেই লেখা হবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নব ইতিহাস। খাস রাইটার্স বিল্ডিং কাঁপিয়ে দেবেন তিন বিপ্লবী। মেজর বিনয় বসুর নেতৃত্বে লড়াই করবেন দুই সৈনিক– দীনেশ ও বাদল । আমাদের এই কিশোরটি হলেন, বাদল ওরফে সুধীর গুপ্ত। ঐতিহাসিক অলিন্দ যুদ্ধে যিনি শহিদ হয়েছিলেন। পুলিশের হাত থেকে কিশোর বিপ্লবীর মৃতদেহ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর কাকামণি তরণীনাথ। এসব যখন হু-হু করে ঘটছে, তরণীনাথের কন্যা ‘খুকু’ তখন ছোটো। সেদিন না বুঝলেও, পরে অবশ্য তিনি নিশ্চিত বুঝেছিলেন, তাঁর একান্ত আপন দাদামণি কবেই যেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছেন। পরবর্তী জীবনে নিজের সন্তানদের কাছে দাদামণির আত্মবলিদান, দেশকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আদর্শ সঞ্চারিত করতে ভোলেননি তিনি। পারিবারিক গল্প থেকে ইতিহাসের সরণি ধরে এই যে পরিক্রমা– তা অক্ষরে ধরে রেখেছেন ‘খুকু’রই পুত্র বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত। এ বই আসলে তাঁর মামার কথা। তাঁর পরিবারের কথা। আবার তাই বা কেবল বলা যায় কী করে! এ যে আসলে ভারতবর্ষ নামেরই এক পরিবারের অসমসাহসী এক সদস্যের জীবন ও বলিদানের ইতিহাস। যাঁর জন্য আজকের ভারতবর্ষ সম্ভবপর হয়েছে।
এই সময়ে, যখন দেশপ্রেম তথা জাতীয়তাবাদ স্বার্থসিদ্ধির রাজনৈতিক বোড়ে হয়ে ব্যবহৃত ও বিকৃত, তখন এই আখ্যান আরও গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে। মায়ের মুখে শোনা গল্প এবং ইতিহাস মিলিয়ে বিশ্বনাথ দাশগুপ্তের এ রচনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তাঁর মামার রাজনৈতিক কাজকর্মের সূত্রেই স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রতিও মনোযোগী হয়েছেন তিনি। ফলে, এই বই একদিকে যেমন বিপ্লবী বাদল গুপ্ত ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নতুন করে অন্য মাত্রায় পরিচয় করিয়ে দেবে, তেমনই চিনিয়ে দেবে বাঙালির আগুন, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম। চিনিয়ে দেবে বাঙালির দেশাত্মবোধ, যা ইতিহাসের কষ্ঠিপাথরে যাচাইকৃত। এই ‘ফেক নিউজ’ ভরা দেশপ্রেমের জোয়ারে এ ইতিহাস তাই প্রকৃতই আমাদের রক্ষাকবচ। পাঠকের দরবারে ব্যক্তিগত সিন্দুক থেকে সেই গুপ্তধনই যেন তুলে দিলেন বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত, আমাদের জন্য, আগামীর জন্য।
Be the first to review “আমার মামা বাদল গুপ্ত”