হেমন্ত কুয়াশা ঝরে পড়ছে টাপুর টুপুর। দিগন্ত বিস্তৃত চর ও অচর ঝাপসা আলো আঁধারি মায়ায় অপেক্ষায় আছে, এক্ষুনি যেন ব্ল্যাক ম্যাজিক দেখাবে কোনও আফ্রিকান জাদুকর। গর্ভবতী চন্দ্রবোড়া সাপেরা দশহাত মাটির তলায় নুড়ি আর বালির লেপ তোশকে চিতোরগড়ের রানির আনন্দে তোফা ঘুমের জোগাড়ে ব্যস্ত। সারারাত শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাস ইতিউতি টুকটুক গল্প করে। সদ্য কিশোরী ধান, বুকের জমে ওঠা দুধের ভাণ্ডারে শিরশির হাওয়া পেয়ে খিলখিল হাসে মাথা দুলিয়ে। সূর্য এই উঠল বলে।
আলগোছে অনিমেষ ভাবনা ছড়িয়ে সরু, কাটা আলপথ পেরিয়ে হনহন চলে লোকটা। মৃদু কুলকুল শব্দে ভুলুকপথে জল এগিয়ে যায় এক সীমানা ছেড়ে অন্য সীমানার দিকে। যাযাবরের নির্দিষ্ট নিয়মের কোনও তোয়াক্কাই করে না সে। কাঁধে ঝুলি, গামছা কিম্বা পাগড়ি, নিদেনপক্ষে হাতে এক গাঁঠওয়ালা তৈলাক্ত বাঁশের লাঠি, এ সব কিছুই তার কাছে অনভ্যস্ত ছদ্মবেশ। মাঠের সীমাহীন আলপথে কুয়াশায় মোড়া ক্ষীণ দৃশ্যমানতায় এগিয়ে চলে লোকটা। তার স্বল্পকেশ আর অনির্দেশ দৃষ্টি সম্বল।
কুকুকুকু আওয়াজে ভৈরবী রাগে বেহালায় ছড় তোলে কোনও মেঘনাদ পাখি। নিকুম্ভিলায় বসার আগে বাজিয়ে নিতে চায় চারপাশের শত্রু অবস্থান। মাঝে মাঝে অরোমান্টিক দাড়িতে হাত বোলায়, চুলকায় লোকটা। গতরাতের নরম মেয়েটার সূক্ষ্ম যোনিভেদের উত্তাল বৃত্তান্ত, এখন আর তার মনে নেই। যেমন মনে নেই কাল সন্ধেয় হাতে গোনা তিন টুকরো রুটি জুটেছিল কিনা ঠিকঠাক! চারদিক সচকিত করে হঠাৎ হাঁচি আসে, গুনে গুনে ঠিক দু-বার।
জীবনের যত ঝর্নাপ্রপাত, বিষাদের সমুদ্রে কল্কেফুলের রঙ পরিবর্তন, সব সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় এই রাত সকালের সন্ধিক্ষণে। চড়া সূর্যের আলোয় নৌকাবিহীন নদীর জলে আলোর ঝলকানি মুহূর্ত বিপর্যস্ত করে না স্বভাব যাযাবরকে। উশকোখুশকো চুলের গোপন কোণ থেকে উঁকি দেয় সূক্ষ্ম রুপোলি রেখা। কত মুখ এল গেল, কত মুখই রয়ে গেল, হারাল অন্ধকারের নিষিদ্ধ গলিতে। লেগে থাকে সময়ের গায়ে কত না বোঝা অভিমান, না পাওয়া আদর। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই এগোয় সে জন। তার কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যত নেই। আছে শুধু কুয়াশাময় নিপাট বর্তমান।
ছেঁড়া ছেঁড়া কাটা স্বপ্ন-নকশায় রাত্রি পার হয়। জঙ্গলের দূর ঘনছায়ায় খটখট শব্দে নিশিবাসর চকিতে জাগিয়ে তোলা সাদা লক্ষ্মীবাহন অজর গমন শেষে ঘরে ফিরে যায়। সেইসব তরুণী কস্তুরি মুখ, অথবা কস্তুরি মুখের হরিণী ছায়া, হেমন্তভোরের চুপিচুপি অভিমান হয়ে কুঁড়ি হয়, ফোটে, ফের ঝরে যায় নাছোড় জাতিস্মর স্মৃতির অক্ষম বাহক হয়ে। অগস্ত্য অভিযানে গালের দু-পাশে বলি ক্রমশ গভীর হয়। আলপথ ধরে ভাঙাচোরা অবয়ব এগিয়েই চলে সকল চাওয়ার হাতের ধরাছোঁয়ার সীমানার বাইরে। আঁকাবাঁকা রঙধনু দিগন্তরেখা একবার হলেও ছোঁবেই সে।
লাল কাঁকুরে ল্যাটেরাইট মাটিতে সূর্য ওঠার আগের হিম আর সকালের প্রারম্ভ রোদ্দুর ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। টলমল পায়ে হাঁটে, খিলখিল হাসে। হাসে আর লুটোপুটি খায়। গায়ে মেখে নেয় লাল ধুলোর আদুরে আস্তরণ। ভাঙে নিজেদের অহং, আজন্ম লালিত সংস্কার, অন্ধ কানাগলির বোধ। ভাঙতে ভাঙতে একসময় বিদ্যুৎ চমকের মতো জন্ম নেয় গোলাপি মুক্তোর খণ্ড।
একমুখ দাড়ি, গোঁফ আর ঝাঁকড়া চুল, কতদিনের না কাচা জামা আর বোতাম ছেঁড়া জিনস সম্বল লোকটা হেঁটে চলে সযত্নে মুক্তোগুলোকে পাশ কাটিয়ে। সম্পূর্ণ উদাস দুটো চোখে পৃথিবীর কোনও অনাচার কিম্বা আপাত দুর্লভ সম্পদমায়া কোনও ছাপই ফেলতে পারে না। একে একে পার হয় রুক্ষ অকৃষিযোগ্য মাঠের আল।
কোন দূরে সদগোপ গৃহস্থ সন্ধানী চাউনিতে খুঁজে ফেরে আগের রাতে গোয়ালের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে না ফেরা গাভীর ঝুন্ড। সেদিকে একঝলক তাকিয়েই এলোমেলো লোকটার মনে পড়ে যায় গতরাতের স্বপ্নে রাগী মোষের লেজ কেটে নেওয়ার বিক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত। ঘুমভাঙা পাখিদের চমকে দিয়ে একাকী প্রান্তর কাঁপিয়ে হা হা করে হেসে ওঠে সে। স্বপ্নেও তাকে পালাতে হয় ক্রুদ্ধ মোষের তাড়া থেকে উদাসীন জীবন বাঁচানোর নিষ্ফল চেষ্টায়।
এইভাবে জীবনও তাড়া করে। আশেপাশে লোভী হাত যখন নির্জন রাতে কাজফেরত যোনির ওপর হামলে পড়ে। নেশাড়ু মননে ফাঁকা রাস্তায় ব্লাউজ ছিঁড়ে অনাবৃত করে সুডৌল স্তন।
যখন বলিরেখা আঁকা মুখের সামনে নেচে বেড়ায় শেষ বয়সের সম্বল দেবার আশ্বাসে অর্থলোলুপ হাত। বহু বসন্ত দেখা বৃদ্ধ চোখের সামনে নেমে আসে গাঢ় শীত। বরফ পড়ে। পাতা হারিয়ে সবুজ গাছেরা মৃতপ্রায়।
যখন চোদ্দো বছরের বিবাহিত জীবনে নপুংসক কিলবিলে হাত শুধু ঘুষি মেরে যায় কোমল প্রত্যঙ্গে। কালশিটে দেখে ভোগ করে নরকের দাউদাউ আনন্দ। চুরি করে বেচে দেয় কামনা মেটানো সোনালি শৈশব।
তখনও লোকটা দৌড়ায়। আধঘন জঙ্গলের আঁকাবাঁকা গাছেদের এড়িয়ে খোলা প্রান্তরের সীমানার দিকে।
খোঁচা খোঁচা আগাছার ভিড়ে শুধু মশাদের গুনগুন। সূর্য ওঠে। লাফ দেয় দেরি হয়ে যাওয়া নৈমিত্তিক দিনের শুরুতে। লোকটা হাঁটে নির্বোধপ্রায় চাউনির মরা আভা দিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে।
কোথাও ধানকলের ভোঁতা সাইরেন জানান দেয় — ভাত দাও গো! বড় খিদে আজ চড়াপড়া এ পেটসর্বস্ব দেহে!
Be the first to review “খণ্ড ক্যানভাস”