বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘মাঝে-মাঝে দুপুরবেলাকে মনে হয় অন্য কোনো দিনের মতো। / যেন একটু ঠেলাতেই খুলে যাবে। একটু। আর-একটু।’ এই প্রবীণা প্রেমিকা কলকাতার দিকে তাকিয়েও কি মাঝে মাঝে সেই একই কথা মনে হয় না? এই রোজকার ঘষটানো যাপনের ঘেমো গন্ধে গোধূলি নেমে আসা শহরটাতেই যখন জ্বরের কবিরা সময় থামিয়ে দেয়, তখন অলক্ষেই টং টং শব্দ তুলে রওনা দেয় এক মায়াবী ট্রাম। মনে হয় সে যেন আর এক অন্য শহর। একটু ঠেলাতেই সে খুলে যাবে আর একটু অন্দরের দিকে, অন্তরের প্রতি। আর-একটু। অন্যরকম। অনেকখানি মায়া মেখে এখনও তো চাঁদ ওঠে কলেজস্ট্রিটের মাথায়। আর বৃষ্টি! তারও তো আসার কথা। কিন্তু কে না জানে, ‘কলকাতা রোদের শহর, বৃষ্টি সেখানে মরশুমী অতিথি’। অথবা কলকাতাই সেই ভালোবাসা, যা আসলে গ্রীষ্মপ্রধান একটা দেশ। এ শহরই অভিসারের রাধা, অথবা স্রেফ এক চায়ের দোকানের মৃদু টুং টাং-এ মিশে যাওয়া, ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাওয়া বেঁচে থাকার মুহূর্তরা। বিবস্বান দত্ত তার ‘খাতার পিছন পাতায়’ সন্ধানে নেমেছেন এই অগ্রন্থিত কলকাতারই।
তথ্য কিংবা তত্ত্বে নয়, অনুভবের রেল ধরেই ছুটেছে মন। তবে ওপর ওপর ছুঁয়ে ওপরচালাকির শহরপ্রেমে মজেননি বিবস্বান। তিনি শহরের শিরা ছুঁয়ে কিংবা নিজের অস্তিত্বের ত্বক সরিয়েই ছুঁয়ে ফেলতে চান সহর্ষ যন্ত্রণা। কংক্রিটের শহরেও তাই তাঁর ডুবসাঁতার অনুশীলন। ফলে এ বইয়ে যে কলকাতা, যে বেঁচে থাকা উঠে আসে তা যেন দুপুরবেলাকে অন্য দিনের মতোই মনে হওয়ার মুহূর্তদের ফিরিয়ে দেয়। না, এ বইয়ে জাদু নেই, বাস্তুবতার ধুলো ছুঁতেও সে নারাজ। তাহলে? এ প্রশ্ন থেকেই রওনা দেয় ওই অলৌকিক ট্রামখানা। আর আমরা বুঝতে পারি আমাদের ভিতরই ডানা মেলছে আর এক কলকাতা। আমরা জানতে পারি আমাদের একটা নিজস্ব ‘ভেতরের কলকাতা’ আছে যেখানে রোজ বৃষ্টি হয়, আর ‘সদ্য নারীজন্ম পাওয়া বালিকা সব লজ্জা মুছে এসে প্রথম বৃষ্টিতে’ নাচতে থাকে। সেই অন্য ও অনন্য কলকাতা নিয়েই বিবস্বানের ‘খাতার পিছন পাতা’।
এখন, কলকাতার প্রতি প্রণয় নিবেদন প্রথম নয়, নতুনও নয়। তবু এ বই কেন হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করে? করে, বিবস্বানের গদ্যের জন্য। অনুভবের অনুবাদ হয় না। তবু অক্ষরের ছাঁদে তাকে ধরার চেষ্টা সকলেই করেন। তবে কে কীভাবে তা করছেন তাতেই ভিন্ন হয় প্রতিমা। গদ্য নিয়ে বিবস্বানের পরীক্ষা নিঃসন্দেহে তরুণ কলমকে আপন করে নিতে ভরসা জোগাবে। আর আস্ত একখানা বই যখন বইপাড়াকে উৎসর্গ করে লেখা হয়, তখন বুকের ভিতর সত্যিই একটা ট্রামের ঘণ্টা বেজে ওঠে না? পাঠক, দেখুন তো ‘খাতার পিছন পাতা’য় কান পেতে সে শব্দ শুনতে পান কি না!
প্রচ্ছদ – রোহণ কুদ্দুস
Be the first to review “খাতার পিছন পাতা”