গরম ভাত

160.00

গৌতম বিশ্বাসের গল্প সংকলন গরম ভাত।

যে গ্রামে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এপারে চলে আসা ছিন্নমূল কিছু মানুষের হাতে গড়ে ওঠা সেই গ্রামে এক সময় না ছিল ঠিকমতো রাস্তা, না ছিল এক পলক চেয়ে দেখার মতো বাড়িঘর। ইলেকট্রিসিটি তখন দূর অস্ত। সন্ধে লাগতেই ঝুপসি আঁধারে ঢেকে যেত পুরো গ্রাম। আলো বলতে তখন মাটির দাওয়ায় টিমটিম করে জ্বলতে থাকা কেরোসিনের কুপি, আকাশের তারা, আর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা কিছু জোনাকি। তাতে পথ চলা দায়। তাই সন্ধে হতেই গ্রামের মানুষগুলো ঢুকে পড়ত যে যার বাড়িতে। রাতের খাওয়া সন্ধের আগেই শেষ। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর তখন বিছানার সান্নিধ্য পেতে ব্যস্ত। আর একবার তা পেলেই শান্তির ঘুম। আমাদের গ্রামটা অনেকখানি ফাঁকা জায়গাকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বি চলে গেছে মাইল দুয়েক। পূর্ব পাশে বিরাট বিল। পশ্চিমে মাঠ। সেই মাঠটা ঢালু হতে হতে নেমে গেছে আরও একটা বিলে। আষাঢ় থেকে ফাল্গুন দুই বিলেই জল থাকত। বাকি সময় তার চওড়া বুক ভরে যেত সবুজ ফসলে। সারি সারি খেত। রাশি রাশি ফসল। এই বিলে তাই একদিকে যেমন দেখেছি জেলে বাগদিদের মাছ মারা, তেমনই দেখেছি মাটির গন্ধ গায়ে মাখা কৃষকের চাষবাস। আমাদের চারপাশে তখন যত মানুষ তাদের সকলেই বলতে গেলে ‘দিন আনি দিন খাই’। সম্ভ্রান্ত পরিবার কিছু ছিল বটে, যাদের একটু বেশি জমিজমা। মুনিশ খাটিয়ে চাষ করে। গোলায় ফসল তোলে। তবে তার সংখ্যাটা বড়োই কম। তখনও ঘরে ঘরে পাম্প মেশিন আসেনি। আকাশের উপর ভরসা করে চাষবাস। চারদিকে কেবলই খিদে। খিদে আমাদের পেটেও। আর সেই পেটভর্তি খিদে মেটাতেই অল্প বয়সে আমারও হাতে তুলে নেওয়া কাস্তে, কোদাল, লাঙ্গল, নিড়ানি। ওই বয়সেই নিজের হাতে ফসল বুনেছি। কেটেছি। ঝাড়াই করে ঘরেও তুলেছি। কত রোদ বর্ষা গিয়েছে মাথার উপর দিয়ে। গায়ের উপর দিয়ে গেছে শীত। আর এসব করতে গিয়েই সেই সব উদোম গায়ের মানুষের সংস্পর্শে আসা। কাছ থেকে দেখা তাদের জীবন সংগ্রাম। দুইবেলা কেবল দুই মুঠো খাবার আর একটু শরীর ঢাকা পোশাকের জন্য কতই না পরিশ্রম। দিন নেই। রাত নেই। গ্রীষ্ম নেই। বর্ষা নেই। জ্বরজারি, অসুখবিসুখ নেই। কেবল খাটো আর খাটো। এমন খেটে খাওয়া জীবন যাদের তাদের জীবনেও সুখ ছিল। দুঃখ ছিল। ভালোবাসা ছিল। ভালোলাগা ছিল। আমার এই দুই চোখ দিয়ে কতই না দেখেছি তাদের। যত দেখেছি, ততই ভেবেছি। আর যত ভেবেছি, ততই কোথায় যেন একটা কষ্ট ঠেলে উঠেছে কেবল। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা কুরে খেয়েছে আমায়। কাকে যেন বলতে ইচ্ছে হয়েছে এদের জীবনের কথা। আর বলতে চাওয়া থেকেই একদিন এই হাতে কলম তুলে নেওয়া আমার।
আমি যা-ই লিখি কখনোই নিজেকে ব্যর্থ বলে ভাবি না। মনে হয় আমি তো এদের কথাই বলতে চেয়েছি। শহরের আলো ঝলমল পরিবেশের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, সেটাই তো আমি জানাতে চেয়েছি। আমার গল্পে তারাই তো চরিত্র হয়ে উঠে আসে বারবার যাদের মধ্যে আমি জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, যাদের জীবনযন্ত্রণাকে কাছ থেকে দেখেছি বারবার। এরা তো নিছক গল্পের চরিত্র নয়। আমার চারপাশের চলে ফিরে বেড়ানো রক্তমাংসেরই মানুষ সবাই। এক মুহূর্ত এদের কথা না বলে আমি পারি না। এরাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এদের কথা। এমনই কিছু মানুষের কথা নিয়ে লেখা কিছু গল্প দুই মলাটে বন্দি করে তুলে দিলাম পাঠকের সামনে। হে পাঠক, এদের কথা পড়তে গিয়ে যদি কোথাও এতটুকু কষ্ট অনুভব হয়, চোখের দৃষ্টি ঈষৎ ঝাপসা হয়ে আসে, অস্পষ্ট হলেও যদি দেখতে পান এদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখগুলো, তাহলে জানবেন আমার মতো আপনিও এদেরই একজন।

গৌতম বিশ্বাস

Customer Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “গরম ভাত”

Your email address will not be published. Required fields are marked *