বেঁচে থাকা যে সর্বদা সুখকর অভিজ্ঞতা তা নয়। তবু আমরা জীবনকে ভালোবাসি। কারণ এই ভালোবাসার মধ্যে, এই বেঁচে থাকার মধ্যে এক ধরনের মাদকতা আছে, পাগলামি আছে, নেশা আছে। এই অদ্ভুত নেশাতেই বোধ হয় ঘুরে চলেছে জীবনচক্র। হাজারো দুঃখ, যন্ত্রণা, ঘিষাপিটা যাপন, তবুও প্রেম, তবুও আলো, তবু জীবনের ফিরে আসে চাকা। তারই উদ্ভাস ধরা পড়ে টুকরো টুকরো আখ্যানে। গল্প তাই যেন জীবনেরই আরশিমহল। শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের এই দৈনন্দিন বেঁচে থাকার জীবন থেকেই ছোট ছোট টুকরো সাজিয়ে নিয়ে তৈরি করেছেন তাঁর আরশিনগর। তবে গল্প বলেই, আখ্যানের বাস্তবতা পারার মতো তার পিছনে লেগে আছে বলেই, জীবন সেখানে প্রতিভাত হয় অন্যরকম হয়ে। ধরা যাক, ওই যে চলেছে একখানা লোকাল ট্রেন, তার সমস্ত ক্যাকোফোনি নিয়ে, সহযাত্রীর অভদ্রতা, অস্বস্তি নিয়ে এই যে মুহূর্ত কয়ের সহাবস্থান– তাও তো আস্ত একটা জীবনেরই গল্প। তারপর যখন আওয়াজ স্তিমিত হয়ে আসে তখন, যেন জীবনের রাগমালা সমে পৌঁছায়। এভাবে দেখতে গেলে সমস্ত হর্ষ-বিষাদই যেন এক একটা রাগমালা ঘরানার ছবি। যখন সামান্য নাচিয়ে থেকে স্টান্টম্যানের পদোন্নতি পেয়েও দিনের শেষে আমাদের চেনা যুবকটিকে বেতনহীন হয়ে ফিরতে হয়, আমরা কি শুনতে পাই না অদূরে বাজছে বিষাদের বাঁশি? কিংবা ওই যে বধূটি কয়লা খাদানে গিয়ে আর ফিরল না, ওই যে কিশোরী চোটের কারণে আর ব্যাডিমিন্টন খেলতে পারল না এবং সে কারণে তার মা-বাবার বচসাও থেমে গেল, সেই নিস্তব্ধতাও আসলে আমাদের হাত ধরে জীবনের অন্য অন্য অনুভবের ভূমিতে এনে দাঁড় করায়। লেখক শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সবই দেখেন একটু দূরত্ব থেকে। ব্যক্ত-আবেগকে সরিয়ে রেখে তিনি যেন উঁচু ওভারব্রিজ থেকে প্রত্যক্ষ করছেন এই চলমান জীবন-ছবি। আর টুকরো টুকরো ধরা পড়ছে যাপনের চমক, শিউরে ওঠা, বিস্মিত হওয়ার উপাদান। এটাই লেখকের মুনশিয়ানা। তথাকথিত চেনা জীবনকেও তিনি চেনাতে পারেন অন্য অর্থে। আর সেখানেই আখ্যানের সার্থকতা।
বিভিন্ন পত্রিকায় শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ফলে পাঠক তাঁর লিখনশৈলী, বিষয় নির্বাচনের সঙ্গে পরিচিত। এই বইয়ে ধরা থাকল ভিন্ন স্বাদের ১৬টি গল্প। আসলে তা জীবনেরই ক্যালাইডোস্কোপ। গল্প যাঁরা পড়তে ভালোবাসেন, আশা করা যায় এ বইয়ে তাঁরা চেনার মাঝে অচেনাকে আবিষ্কারের রসদ পাবেন। তবে শেষমেশ এই বই কোন ছুটির ইঙ্গিত দিচ্ছে? জীবনে অনুরক্ত এই কথনমালা কেন ছুটির বিরতিতে পৌঁছচ্ছে? সে জন্য বইয়ের শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেই হবে।
Be the first to review “ছুটি”