এই সংকলনে থাকছে অমর মিত্রের তিনটি উপন্যাস — ‘নয় পাহাড়ের উপাখ্যান’, ‘নিসর্গের শোকগাথা’ ও ‘হে নবীন সন্ন্যাসী’। ব্যাপ্তিতে ও ব্যঞ্জনায় উপন্যাসগুলি জনজীবনের গভীর থেকে গভীরতর তল স্পর্শ করে। স্থানিক সংস্কৃতি, লোকায়ত উপকথা, ইতিহাসের তথ্য সেখানে ছায়া ফেলে। সেইসব উপাদানের আশ্চর্য মিশ্রণেই লেখক গড়ে তোলেন তাঁর এক একটা উপন্যাসের ইমারত।
বাঁকুড়া জেলার মানুষ আর প্রকৃতি মিশে থাকে ‘নয় পাহাড়ের উপাখ্যান’-এ। ন-পাহাড়ি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, বিধান রায় বেঁচে থাকলে এই জনপদের চেহারা কেমন বদলে যেতে পারত। সে-কথা শোনেন ওখানে চাকরি করতে আসা যতীন সামন্ত। এরপর আমরা দেখি, একটি মেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে কী করে একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে ন-পাহাড়। ভাদুগান থেকে লোকজ সংস্কৃতির টুকরো উপাখ্যান মিশে থাকে কাহিনিতে। ক্রমে আমরা আবিষ্কার করি এ কাহিনি যেন আমাদের জীবনবদলের-ই দ্যোতক হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকে বিপর্যয়। বিপর্যয় যেমনই হোক না কেন, জনজীবনকে তা কতটা বিধ্বস্ত, অসহায় করে তোলে- এ উপন্যাস তার সন্ধান করে। নিসর্গের অনন্ত শোকগাথা ধ্বনিত হলে মানুষের হাহাকার-ও যেন শব্দহীন। আর তারই ভিতর ঘনিয়ে ওঠে রাজনীতি। ত্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা। এ-উপন্যাস যেন আমাদের অস্তিত্বশীলতার মূল প্রশ্নের দিকে ফিরিয়ে দেয়। বেঁচে-থাকার এই উদযাপনে প্রকৃতি ধ্বংসের খেসারত, রাজনীতির দাবা যে মানবজীবনকেই কতখানি আবাদহীন করুণ ও বিষণ্ণ করে তোলে, তার মুখোমুখি হতে হয় পাঠককে।
‘হে নবীন সন্ন্যাসী’ রণ-রক্ত-সফলতার ভিতরে সভ্যতার শান্তির প্রদীপ খুঁজে চলে। কাহিনিতে আসে মারী প্রসঙ্গ। আসে, ধর্মীয় গোঁড়ামি। মানুষের উগ্রতায় মানুষেরই বিপর্যয়ের আখ্যান। তার পাশেই থাকে বুদ্ধের শান্ত সমাহিত দর্শন। এ উপন্যাস আমাদের শাশ্বত জীবনপ্রবাহের স্রোতের সন্ধান দেয়, শত ঝঞ্ঝা পেরিয়েও যা বয়ে চলেছে অচঞ্চল।
বিষয়ে, বৈচিত্রে পাঠককে এক অক্ষ থেকে অন্য অক্ষে টেনে নিয়ে যান লেখক। কাহিনি পেরিয়ে অন্তঃস্থ দর্শনেই উপন্যাসগুলি হয়ে ওঠে সচেতনভাবে সমকালীন।
Be the first to review “তিনটি উপন্যাস”