সুস্থতায় মহৌষধি হল হাস্যরস। চ্যাপলিন থেকে বায়রন সকলেই এই বিষয়ে একমত। হাসিই নাকি সেই সূর্যকিরণ, যা আমাদের মুখের শীত কিংবা মনের কুয়াশা মুছে দিতে পারে। এ অবশ্য জানা কথা। সেই সঙ্গে সুকুমার রায়ের সতর্কবার্তাও অজানা নয় যে, আর যেখানেই যাও না কেন, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার। কিন্তু ওই যে, যেখানে কাতুকুতুর ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। ফলে কিছু কিছু হাসির উপকরণের নমুনা দেখে চোখে আঁধার ছাড়া আর কিছু জোটে না। বিশেষত মিম-খিল্লি সমৃদ্ধ সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্বে হাসি বলতে যা ভাগাভাগি হয়, তা দেখে হাসিরই হাসি পেয়ে যাওয়ার কথা। এই ফিকে হাসির সস্তা রোগের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছেন সুজন দাশগুপ্ত। তাঁর কাহিনির পরতে পরতে হাস্যরস আছে অবশ্যই, তবে তার সর্বাঙ্গে মিশে আছে এক অভিজাত আবেদন।
‘নিভৃতে’র কাহিনি নির্মাণে আসলে এক শৌখিন শালকেই যেন ভাঁজে ভাঁজে খুলেছেন সুজন দাশগুপ্ত। যেন আটপৌরের প্রাত্যহিকতা পেরিয়ে তা যত্ন করে তোলা ছিল। অথচ তার এক ভাঁজও আমাদের অচেনা নয়। সেখানে রাখা আছে সংসারের ওম, মিঠে রোদের গল্প। এই যে এক মা ছেলের বিয়ের জন্য ব্যস্ত, এই যে কথায় কথায় তিনি একটু বেশিই কথা বলেন, তারপর এই যে দাপুটে দিদির কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত হাইলি কোয়ালিফায়েড জামাইবাবু– বাঙালি জীবনে এর কোনোটা অচেনাও নয়, অস্বাভাবিকও নয়। সুজনবাবু এই সাধারণ উপকরণগুলি নিয়েই এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেন, জীবনকে বইয়ে দেন এমন খাতে যেখানে হাসির মিটিমিটি আলো জোনাকি হয়ে ওঠে। আর সেই আলো-আঁধারির ভিতর আমরা দেখি কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে প্রেমও। একটা সংসারের আবছা-অবয়ব, অনেকখানি মায়া সিচুয়েশনল কমেডির আড়ালে আবডালে ছড়িয়ে দিতে থাকেন লেখক। শেষমেশ গন্তব্যে পৌঁছে তাই এই অভিজাত শালখানাকে মনে জড়িয়ে নিতেই বড্ড ইচ্ছে করে। এখানেই লেখকের মুনশিয়ানা। কাতুকুতু বুড়োর থেকে শতহস্ত দূরে দাঁড়িয়ে তিনি তৈরি করেন একটি রাত, যে রাত ফুরিয়ে গেলেও খানিক মিঠে মনখারাপ থাকে, আবার এমন কিছু ভালোও শেষে তোলা থাকে যাতে, মনভালোয় মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সুজন দাশগুপ্তের মতো কুশলী লেখক এই জটিল কাজটাই করেন এত সহজভাবে, কখন যে বই শেষ হয়ে যায়, ঘড়িও পাল্লা দিতে পারে না। এমনই এক কাহিনি– ‘নিভৃতে’; যে বইকে প্রকৃত পাঠকমাত্রই আপন করে নিতে দ্বিতীয়বার ভাববেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ — সুমিত রায়
Be the first to review “নিভৃতে”