“গাজায় যারা থাকে, তাদের ভয় কেমন তা দুনিয়ায় কেউ কল্পনাই করতে পারবে না। ভয় শুধু পুরো পরিবারকে নিয়ে মৃত্যুপথে যাওয়া নয়। পরিবারের কেউ বোমার আঘাতে তৎক্ষণাৎ মরল, আর বাকিরা আহত হয়ে ভাঙা ঘরের নীচে দমবন্ধ হয়ে পড়ে রইল, হয়তো আস্তে আস্তে মরবে, ক্রমাগত রক্তক্ষরণের ফলে, বা অনেকটা সময় ধরে খাবার ও জলের অভাবে— সেই ভয়টা আরও বেশি।”
“আপনি কি একটি গাজার শিশুর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী? অবশ্য, ধরে নেওয়া যাক, এই গণহত্যার শেষ হলেও সে বেঁচে থাকবে। ধরে নেওয়া যাক, এই গণহত্যার শেষ আছে।
শিশুটিকে কী বলবেন আপনি?
ওর, ওর মতন অন্য শিশুদের জীবন আর বাসস্থান রক্ষা করতে আপনি কী করেছেন? কী করেছে আপনার সরকার?”
এই কথাগুলো মোসাব আবু তোহার সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া। রাফা সীমান্ত পার করে, আইডিএফ (নিন্দুকে বলছে আইওএফ— ইসরায়েল অকুপেশন ফোর্স)-এর হাতে লাঞ্ছিত ও পীড়িত হয়েও মোসাব পৌঁছেছেন মিশরে। তাঁর শিশুসন্তানদের ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি। কারণ তাঁর একটি মেয়ে জন্মসূত্রে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তবে তাঁর মা ও বাবা, ভাইবোনেরা আর তাঁদের সন্তানসন্ততি এখনও গাজাতেই। ধরে নেওয়া যাক তাঁরা জীবিত আছেন। ধরে নিতে হবে, কারণ এঁদের সংবাদ সরাসরি পাবার কোনও উপায় মোসাবের নেই। নানান কুটুম-বন্ধুর মারফত মাঝেমধ্যে খবর আসে, এই। নিকটাত্মীয়েরা মোটের উপর জীবিত থাকলেও এই যুদ্ধে মোসাব হারিয়েছেন, আরও পাঁচজন প্যালেস্টাইনবাসীর মতন, অনেক বন্ধু, পড়শিদের।
মোসাব আবু তোহা যে একজন কবি, সে কথা তো এতক্ষণে ধরেই নেওয়া গেছে। এ ছাড়াও তিনি একজন ছোটোগল্পকার। মোসাবের জন্ম নেই-দেশ প্যালেস্টাইনের গাজায়। ইংরিজি ভাষার স্নাতক। ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তুদের কল্যাণে তৈরি রাষ্ট্রসংঘের স্কুলগুলিতে ছিলেন ইংরিজি ভাষার শিক্ষক। গণতহবিল গঠন করে তার সাহায্যে গাজায় তৈরি করেছেন এডওয়ার্ড সাঈদ-এর নামে সাধারণ গ্রন্থাগার, যা কালক্রমে আরও একটি শাখায় পল্লবিত হয়েছে। এই গ্রন্থাগার, ঘটনাচক্রে, গাজার একমাত্র ইংরাজি ভাষার গ্রন্থাগার।
যুদ্ধের ফলে গাজার গ্রন্থাগারগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার পর সাঈদ গ্রন্থাগার তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৪ সালে মোসাব স্ব-উদ্যোগে ইংরিজি বইয়ের দান নিতে শুরু করেন। অনেকের মতো নোম চমস্কিরও অনেক বই এই গ্রন্থাগারে স্থান পায়। নিজ সংগ্রহ থেকে বই দান করে এই গ্রন্থাগার সম্বন্ধে চমস্কি লিখে দেন— “এক অনন্য সম্পদ, অধিকন্তু এক আশ্রয়, আলোর বিরল রশ্মি, গাজার যুবকদের কাছে আশার বার্তা।” বাস্তবে অবশ্য এই গ্রন্থাগারের ভাগ্য মানুষের চেয়ে বেশি কিছু ভালো হয়নি। গ্রন্থাগার, তার বইগুলোকে নিয়ে অন্য পাঁচটা মানুষের মতোই আগ্রাসনের ধুলো-ধোঁয়া নিয়ে প্রাণত্যাগ করেছে। তবে, বইয়ের একটা সুবিধা হল, মরার আগে ঠান্ডায় তারা কষ্ট পায় না।
২০১৯-২০ পঠনবর্ষে মোসাব ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অতিথি কবি। সাহিত্য ছাড়াও মোসাব অ্যারোস্মিথ প্রেসের কলামলিখিয়ে, এবং গাজায় বসে লেখা মোসাবের নিবন্ধ ‘দ্য নেশন অ্যান্ড লিটরারি হাব’-এর মতো মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
মোসাবের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ২০২১ সালে। ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় তাঁর কবিতা আমাকে বিস্মিত করে। পূর্বে প্যালেস্টাইনের কবিদের কবিকৃতির সঙ্গে আমার পরিচয় একেবারে ছিল না তা নয়। মাহমুদ দারউইশ, মুরিদ বারগুতি, ইব্রাহিম নাসরাল্লাহ, জাকারিয়া মোহাম্মদ, জুবের আবু শায়েব প্রমুখের কবিতা কিছু কিছু পড়ার এবং খেলাচ্ছলে অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু সেই পাঠের সবটাই ছিল আরবি থেকে ইংরিজিতে অনূদিত কবিতার। মোসাবের কবিতাগুলি ইংরিজিতেই লেখা বলে একটা সরাসরি যোগাযোগ হল, এবং আমি বিস্মিত হতে থাকলাম শরণার্থী শিবির, কাছের কিন্তু প্রায় অধরা সমুদ্রের ঢেউ, বিস্ফোরণের পর রাস্তায় পড়ে থাকা দরজা— এসবের ছবি দেখতে পেয়ে। ধ্বংস, মৃত্যু, ভয়, বেদনা— এসব তো ছিলই।
আনন্দের কথা এই, যে মোসাবের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের জুন মাসে। বইয়ের নাম ‘থিংস ইউ মে ফাইন্ড হিডন ইন মাই ইয়ার: পোয়েমস ফ্রম গাজা’। বইটির প্রকাশক সিটি লাইটস বুকস। বইটি আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড ও প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে, এবং ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কল অ্যাওয়ার্ডের জন্য কবিতা বিভাগে ও ওয়ালকট পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ডের জন্য চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই সংকলনে অন্যান্য কবিতার সঙ্গে এই বই থেকেও কিছু কবিতা নেওয়া হয়েছে। এই কবিতাগুলোর অনুবাদ ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে আমাদের বাধিত করেছেন বইয়ের প্রকাশক। অন্যান্য কবিতাগুলির অধিকাংশই মোসাবের আগ্রহে প্রাপ্ত।
আমার মতো অনামী অনুবাদকের কাজ নিয়ে বই করার সাহস দেখানো, এ কেবল সৃষ্টিসুখ প্রকাশনের পক্ষেই মানানসই। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। কবি ও অধ্যাপক নিরুপম চক্রবর্তীকে আমার প্রণাম। উনি চিরকাল আমাকে সাংঘাতিক রকমের প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন, এবং এবারেও তার কোনও ব্যত্যয় হয়নি। নিরুপমদা আমার পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠক। পাণ্ডুলিপির অনেক ভুলভ্রান্তি তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন বলে প্রকাশকের মুখঝামটা থেকে রক্ষা পেয়েছি। আরেক কবি ও অধ্যাপক, তদুপরি বন্ধুবর অমিতাভ মুখোপাধ্যায় পাণ্ডুলিপিকে বইয়ের চেহারা দেবার সাহস দিয়েছে। সনেটের গোঁজামিলগুলোও দেখিয়ে দিয়ে ঠিক করে নিতে সাহায্য করেছে। তাঁকেও কৃতজ্ঞতা জানাই।
শিল্পী হিরণ মিত্রকেও আমাদের দু-তরফের অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। হিরণদাকে পাণ্ডুলিপি পাঠাতে প্রচ্ছদ করতে সম্মত তো হলেনই, অধিকন্তু কবিতার অলংকরণে ব্যবহার করার জন্য যা কথা ছিল, বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি ছবি এঁকে দিলেন।
আমি ও প্রকাশক চেয়েছিলাম এই বইয়ের গোড়ার কথা লিখুন মোসাব নিজেই। কিন্তু যুদ্ধ এসে পড়ায় এই পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হল। তবু, সেই ২০২১ সাল থেকে তাঁর বন্ধুসুলভ সমাদর না পেলে যে এই কাজটা করা হয়ে উঠত না, এই কথাটা স্বীকার করে নিই।
আমি নিজে কখনও প্যালেস্টাইন বা ইজরায়েল যাইনি। মধ্যপ্রাচ্যে আমার দৌড় তেহরান শহর ও আমিরশাহির বিলাসীপাড়া দুবাই পর্যন্তই। আমার প্যালেস্টাইন চেনা তাই বই আর ইউটিউবের মাধ্যমে। তবু, কবিতাগুলো অনুবাদের সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেছি আমার কাছে পৌঁছনো ছবিগুলো, আমার কানে পৌঁছনো কথাগুলো বাংলা অক্ষরে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। পড়ে পড়ে মার খেতে থাকা মানুষগুলোর অসহায়তা আর রাগের একটুও যদি আপনাদের কাছে পৌঁছয়, তবে মনে করব কিছুটা কাজের কাজ হল। এই প্রসঙ্গে বলি, সদ্য জেনেছি বিশিষ্ট সাংবাদিক ও তরজমাকার নীলাঞ্জন হাজরা নজোয়ান দরবিশ (উনি এভাবেই লেখেন)-এর কবিতার তরজমা করেছেন। এ ব্যাপারে ওঁর ব্যুৎপত্তির কথা রসিক পাঠকমাত্রেই জানেন। তাঁরা সেই কাজটিকে যথাযোগ্য সম্মান জানাবেন, এই আশা রাখছি। চালু আখ্যানের বাইরের কাহিনিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার সময় এসেছে। কান্না শুনতে গেলে কান তো পাততে হবেই।
ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
Be the first to review “মাথা তুলে দাঁড়ানো গোলাপ”