‘দিনপঞ্জি মানুষের মনের নিকটতম লেখা’ – বলেছিলেন বিনয় মজুমদার। রোজনামচার ভিতর তাই প্রাত্যহিকতা থাকলেও এই নিকটতম বা প্রাইমাল হয়ে ওঠার গুণেই তা মনের কাছাকাছি হয়ে ওঠে। মণিমেখলা মাইতির প্রকাশিতব্য বই ‘রোজনামচা’র ভিতর সেই আলোটুকু আছে, আছে বলেই অন্য কারও জীবনের বেলা-অবেলাগুলোও আর একজনকে স্পর্শ করতে পারে। একজনের নাড়ির স্পন্দন অক্ষর ছুঁয়েই টের পেতে পারেন আর একজন।
আসলে স্রেফ প্রাত্যহিকতায় ভারাক্রান্ত রোজনামচা তো লেখেননি মণিমেখলা। তিনি নিজেকে খুঁড়ে তুলে এনেছেন স্মৃতি-জোনাকি। তার কোনোটি একটু বেশি অতীতের, কোনোটির সঙ্গে হয়তো সময়ের দূরত্ব ততটাও নয়। স্মৃতি আসলে ফেলে আসা যাপনের সাক্ষ্য। ফলে তাতে মিশতে থাকে নানা অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি। কোনও সমসাময়িক ঘটনার সাপেক্ষে তাই চকিতে চলে আসেন গান্ধিজী, কিংবা নিবেদিতার কথা। আবার সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের শিহরিত করে, যখন দেখি লেখিকার পাশে এসে বসেছেন পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জীবন স্বতন্ত্র। কেন্দ্রে থাকেন একজন মানুষ। কিন্তু সেই এক জীবনের পরিধির মধ্যে ঢুকে পড়েন বহু মানুষ, তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা, চেতনা, উপলব্ধি। এ রোজনামচায় তাই কখনও লেখিকা ফিরে যান রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র-র কাছে। কখনও আবার রবার্ট লিন্ড মনে পড়ে যায় তাঁর। জীবন তো এমনই। বহু শাখে, বহু পুষ্পে ক্ষরিত মধু। সেটুকুই ছেনে নিয়ে এসে মণিমেখলা যে রোজনামচা আমাদের সামনে রাখেন, তা আমাদেরও দেয় এক অনির্বচনীয় স্বাদ। পাতা ওলটাতে ওলটাতে কোথাও একটা আমরাও এ জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠি। লেখিকার কলমের গুণ এমনই যে, তিনি এক ঝটকায় তাঁর নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতার ভিতর পাঠককে টেনে নিতে পারেন। সেটা ওই প্রাইমাল হওয়ার কারণেই। ‘রোজনামচা’র ভিতরে যে যাপনের দর্শন থাকে, সেটাই পাঠকের প্রাপ্তি। মণিমেখলার এ সফরে পাঠক অংশীদার হলে, এ প্রাপ্তি মোটেও হাতছাড়া হবে না, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
প্রচ্ছদ ফোটোগ্রাফ – এভগেনি করনোদেভ
প্রচ্ছদ নামাঙ্কণ – উর্বা চৌধুরী
বইটি সম্পর্কে ‘সুখবর’ দৈনিকে প্রকাশিত আলোচনা।
Be the first to review “রোজনামচা”