প্রথম গল্প ‘স্বর্গাদপী গরিয়সী’ কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প। সত্যি বলতে কী, গল্প হিসাবে খুব পোক্ত হয়তো লেখাটি নয়, কিন্তু গদ্যের টানে পাঠক শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলবেন একটানে। আর এই গদ্যের অনায়াস চলনই এশরারের ট্রেডমার্ক। গল্প বলার কায়দাটা তাঁর রপ্ত।
দ্বিতীয় গল্প ‘পতন’। সংকলনের সম্ভবত দুর্বলতম গল্প। গল্পটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। একইভাবে আরও দুটো গল্প — ‘মর্নিং ওয়াক’ এবং ‘তৃতীয় দিন’ পরে বইটি আবার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে সংকলনে না থাকলেও হয়ত চলত।
তৃতীয় গল্প ‘সন্ধে নামার পর’-এর পটভূমিকা রূঢ় বাস্তব। তরুণীদের প্রেমের ফাঁদের ফেলে তাদের হোটেল রুমে ডেকে এনে গোপন মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ডিং করে ব্ল্যাকমেল করত মোজাফফর। এমনকী তার দাবী অনুসারে টাকা না দিলে সেইসব ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করতেও পিছপা হত না সে। তারপর সেই মেয়েদের সামনে আত্মহত্যা বা লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা থাকত না। এমন পটভূমিকায় যা ঘটল, তা নিয়ে এর বেশি লিখলে গল্পটাই মাঠে মারা যাবে।
পরের গল্প ‘লক্ষ যোজন দূরে’। মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনা স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিপুণ গল্পকারের কলমে একটা শক্তিশালী ছোটগল্প হয়ে উঠেছে। এই গল্পটি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে লেখা ‘এক রাত্রি’ এবং ‘গ্রে’জ অ্যানাটমিও’ যথেষ্ট নাটকীয়, উপভোগ্য।
তবে এই লেখকের খুব শক্তিশালী জায়গা সম্ভবত মানুষের অন্ধকার দিক নিয়ে বোনা গল্প। যেমন ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়’। বাংলা সাহিত্যে বীভৎস রসকে আশ্রয় করে লেখালেখি খুব কম চোখে পড়ে। এই গল্পটি তার সার্থক উদাহরণ। আরও একটি গল্প ‘শিক্ষক, তক্ষক’। মানুষের রিরংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণাকে অহেতুক বিশ্লেষণ না করে তাকে যথাযথভাবে হাজির করেছেন লেখক খুব ছোট ছোট ঘটনায় আর বর্ণনায়। একটা আচমকা শর্ট ফিল্ম যেন। মানুষের অন্ধকার নিয়ে লেখা হয়েছে ‘স্ফটিক বাড়ি’ গল্পটিও। ব্যক্তিগতভাবে এই গল্পটি বড় প্রিয় আমার। যেমনটা আগেই বলেছি, এই গল্পের সূত্রেই লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয়।
বাংলাদেশের বর্তমান পটভূমিকায় লেখা ‘থাকে শুধু অন্ধকার’। একজন মা খুঁজে চলেছেন তাঁর নিখোঁজ সন্তানকে। মর্গ থেকে শুরু করে পুলিশ হাজত, এনকাউন্টার স্পট — আশা-আশংকার দোলাচলে পাঠকও অনুসরণ করে চলেন এক মাতৃহৃদয়কে।
এশরার লতিফের গদ্যের ভাষা সহজ, সুখপাঠ্য। প্লট দুর্বল হোক বা ঠাসবুনোট — পাঠককে গল্পের মধ্যে টেনে রাখার ক্ষমতা তাঁর আয়ত্তে। এশরার আরও লিখুন, ভালো লিখুন — তাঁর পাঠক হিসাবে সাগ্রহে অপেক্ষা করছি।
— রোহণ কুদ্দুস