ভদ্রলোককে আমরা ‘সিধু জেঠু’ নামেই ডাকি। আমরা মানে আমার পুত্রসহ পরিবারের সকলেই। বছর চারেক আগে এক রবিবার প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। উলটোদিক থেকে এসে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যালো ইয়াং ফ্রেন্ডস, আই অ্যাম সিধু চৌধুরী।’
পরের রবিবারগুলোয় দেখেছিলাম ভদ্রলোক নতুন মানুষ দেখলেই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করেন। প্রয়োজনমতো বাংলা, তেলুগু, হিন্দি অথবা ইংরাজিতে বাক্যালাপ করেন। পূর্বপরিচিতদের ‘গুড মর্নিং’ বলেন আর ভালোমন্দ খোঁজ নেন।
সেই বাক্যালাপের সূত্রেই একদিন জানা গেল ভদ্রলোকের একক সাইকেল ভ্রমণের কথা। ধীরে ধীরে তাঁর বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনা হল। ভ্রমণকালে নেপালের বনে গাছের ডালে রাত কাটিয়েছেন। দুরন্ত বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে অথবা সাইকেলের সামনে ছুটে আসা গোরুর ধাক্কায় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। নালন্দা থেকে গয়া যাওয়ার পথে দুষ্কৃতির হাতে মার খেয়েছেন। মতিহারিতে লু লেগে নাক থেকে রক্তপাত হয়ে নেতিয়ে পড়ে থেকেছেন গাছতলায়। চম্বলে ডাকাতের হাতে বন্দি হয়েছেন। কুমায়ুন থেকে গাড়োয়ালে যেতে যেতে আচমকা তুষারপাতে ঠান্ডায় জমে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। নীলগিরিতে বুনো হাতির তাড়া খেয়ে উলটে পড়েছেন রাস্তার বাঁকে। প্রতিবার স্থানীয় মানুষরা তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। বিহারের মানুষ এগিয়ে দিয়েছেন ঠান্ডা লেবুজল। উত্তরাঞ্চলের মানুষ দিয়েছেন উষ্ণ পানীয়। কখনও আহত অচেতন পর্যটককে তাঁরাই তুলে নিয়ে ভরতি করে দিয়েছেন হাসপাতালে।
শুনতে শুনতে ছবির মতো দেখতে পেয়েছি এই একই মানুষ কখনও আধুনিক শহরের ঝাঁ ঝকঝকে রেস্তোরাঁয় ডিনার করছেন, কখনও আবার স্রেফ তরমুজ অথবা নিছক ভরপেট জল খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছেন। কখনও রাত কাটাচ্ছেন রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের খাটিয়ায় কখনও বিলাসবহুল বাংলোর নরম বিছানায়। কখনও হিমাচলের কোলে রাকেশ রোশনের পাশে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছেন, ছবি তুলছেন হেমা মালিনী, কখনও আবার রাষ্ট্রপতি ভবনে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির সামনে ভারতবর্ষের গ্রামের কথা তুলে ধরছেন। কখনও শত শত মানুষের অভিনন্দনে ভেসে যাচ্ছেন, কখনও আবার জনহীন অঞ্চলে জলে ভিজতে ভিজতে শ্বাপদ সংকুল দুর্গম পথ অতিক্রম করছেন সাইকেল ঠেলে ঠেলে। তিনি আসাম, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র অথবা গুজরাটের গ্রামের মানুষের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন নিঃসংকোচে। অতিথি হয়েছেন হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের গৃহে। ভাষা বা ধর্ম কোথাও তাঁর চলার পথে অন্তরায় হয়নি।
ভারতবর্ষ ছাড়াও তার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে নেপাল, ভুটান এবং সিকিমেও পা রেখেছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ দর্শন তাঁর কাছে যেমন আনন্দের তেমনই বেদনাবহ। কাজী নজরুলকে সামনে থেকে দেখা এবং শ্রদ্ধা জানাতে পারাকে তিনি পরম সৌভাগ্য মনে করেন।
তাই সিধুজেঠু যখন তাঁর কথা আমায় লিখতে বলেছিলেন আমি আগ্রহ ভরে এগিয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি কাজটা কতটা কঠিন! আমার জন্ম পূর্ববর্তী সময়ের কথা মুখে শোনা অথবা শুনে গল্পগুজব করা এক জিনিস আর তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে লেখা আর এক। অনেকবার মনে মনে হাল ছেড়ে দিয়েছি। তখনই আবার বয়স্ক ভদ্রলোকের একটা কথা কানে বেজে উঠেছে, “এটুকুই রেখে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে থাকতে হবে তো?”
তাই পিছিয়ে আসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারিনি। বইয়ে যে মুভমেন্ট ডায়েরির কথা আছে সেই হলুদ হয়ে যাওয়া ডায়েরি ধরে শুরু করেছিলাম। তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে, ইতিহাস, ভূগোল বই ঘেঁটে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তার মাঝেই এসে পড়ল জীবনের ছন্দ ওলটপালট করে দেওয়া সময়। কোভিড অতিমারি। দুশ্চিন্তা আর হতাশার কারণে লেখা বন্ধ হয়ে গেল। শুনলাম সিধুজেঠু নিজেও দুবার হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন। অমন মানুষ ঘরবন্দি হয়ে আছেন, ভাবা যায় না। তাই হতাশা কাটাতে ধুলো ঝেড়ে বসতেই হল! লিখে কোনও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি হোক বা না হোক, এই দুর্বহ পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও মুক্তি পাব, ভেবে আবার শুরু করলাম। সিধুজেঠুর পাশে এসে দাঁড়ালেন ওঁর ছেলেমেয়েরা। আমার পাশে আমার পরিবারের দুই সদস্য। সৃষ্টিসুখ থেকে রোহণ আগ্রহ দেখাল। শেষপর্যন্ত পান্ডুলিপি নির্মাণ শেষ হল।
এ অভিজ্ঞতা নিছক বই লেখা নয়। এও এক ভ্রমণ। যেন এক দীর্ঘ যাত্রা। তাই এই যাত্রায় যারা পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁদের সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
নীতা মণ্ডল
Be the first to review “সিধু চৌধুরীর সাইকেল ভ্রমণ”