পৃথিবীর আদিতম গল্পটি বোধহয় ‘গ’, ‘ল’ আর ‘প’— এই তিনটি বর্ণের সমাহারে তৈরি হয়েছিল। তারপর অনেক পথ ঘুরেই চলেছে সে। মা, ঠাকুমা, দাদু, দিদা বা অন্য কারও গলায় গল্প শোনার সৌভাগ্যও আমাদের অনেকের হয়েছে। সেইসব গল্পের চেহারা বদলেছে বারবার। ছোটগল্পের থেকেও আরও ছোট— অণুগল্প এসেছে সেই রূপান্তরের পথ ধরে।
অণুগল্পের ব্যঞ্জনা আছে, চিন্তাভাবনাকে চালিত করার মতো শক্তি আছে, আবার নির্দিষ্ট একটি সংক্ষিপ্ত আকারে পরিসমাপ্তিও আছে। শব্দসংখ্যা সীমিত, তাই ‘বলা’ আছে। ‘কওয়া’ নেই। তীক্ষ্ণ শলাকায় বিদ্ধ করার মতো শক্তি রাখে সে। কিন্তু আলাপের সা-রে-গা-মা সাধে না। ঘোমটা দেওয়া বউটির মতো তার রূপের ইঙ্গিত আসে ঘোমটার আড়াল থেকেই, পাপড়ি ঢাকা ফুলের কুঁড়ির মতো সুগন্ধের ইশারা তার অন্তরে। কবিতার মতো সে ব্যক্ত হয়েও অব্যক্ত। কিছু সে বলে, বাকিটা বুঝে নিতে হয়। সেই অণুগল্পকে ধরতে চেয়েছি আমরা এই সংকলনে। ৬০ জন লেখক তাঁদের কলমে অণুগল্পের যে সম্ভার সাজিয়েছেন, সেটিকেই দুটি মলাটের মধ্যে আনার প্রয়াস ছিল। পাঠক বলবেন তা কতটা সার্থক হল।
মাঝে মাঝে মনে হয় অণুগল্প, অণুকবিতার সংক্ষিপ্ত বিস্তার আমাদের সাহিত্যবিমুখ করে তুলবে না তো? কম সময়ের এই প্রাপ্তির ফলে বড় রকমের অবগাহনের স্বাদ পাওয়ার ইচ্ছে হারিয়ে যায় যদি? বাংলা সাহিত্যের সোনার ফসল যদি অবহেলিত হয় এই অণুদের কল্যাণে, নিজেকে সান্ত্বনা দেব কীভাবে?
তারপরেই মনে হয় ইচ্ছের তো কোনও শেষ নেই। সেই ইচ্ছের গাছে রংবেরঙের বাহারি ফুল হয়ে থাকুক না এইসব অণুগল্পগুলো। অল্প কয়েকটি লাইনে সাহিত্যরসের অমৃতধারা যদি হৃদয় স্পর্শ করে, তা থেকেই বা বঞ্চিত হই কেন? গা-ভরা গয়না পরা প্রতিমার মুখশ্রীতে ছোট্ট নাকছাবির মতো, অণুগল্পের উপস্থিতিটুকু সাহিত্যের অঙ্গনে আরও আরও লাবণ্যময় হয়ে উঠুক— সেই শুভ প্রেরণাটুকু নিয়ে এই পথচলা। সার্থকতা অনেক বড় কথা, তাকে তো ছোট এই সময়ের পরিধিতে বেঁধে ফেলা যায় না। সেটার অপেক্ষায় বসেই থাকি না হয়।
আর দু-একটি কথা বলেই এ প্রসঙ্গে ইতি টানব। প্রথমেই বলি, সৃষ্টিসুখ প্রকাশনের কথা। এ বছরের বইমেলায় তাদের বেশ কিছু বই প্রকাশিত। আরও নতুন বই ভবিষ্যতে সংযোজিত হবে। সেই তালিকায় অণুগল্পের সংকলন এই ‘অণুগল্পমালা ১’ বইটিও যুক্ত হল।
নানা স্বাদের নানা বর্ণের ষাটটি অণুগল্প নিয়ে সাজানো এই বইটি প্রকাশের জন্যে নিজেদের লেখা দিয়ে যেসব লেখক সহায়তা করেছেন, তাঁদের আমার তরফে এবং সৃষ্টিসুখের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সৃষ্টিসুখের অগ্রণী ভূমিকা অণুগল্পের লেখকদের সদর্থক ইচ্ছা এবং অকৃপণ লেখনীর দানে পূর্ণতা পাবে, এই আশা ভরসা নিয়েই আমার এই ‘অণু’ঘটকের ভূমিকা। ভুল-ত্রুটির জন্য তাই আগেই মাফ চেয়ে রাখি।
আসুন, আমরা সকলে এই বইয়ের পাতা উলটে দেখি ছোট ছোট অণুগল্পগুলো কত দূরের পথ পাড়ি দিল। তারা কি কোথাও পৌঁছল? তাদের কি দেখা হল সেই ‘গ’, ‘ল’ আর ‘প’-এর সঙ্গে?
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
Be the first to review “অণুগল্পমালা ১”