কিছু মেয়ে থাকে না যাদের আমরা next door girl বলি। কালো রোগা শ্যামলা। ফ্রকজামার পেছনে সেফটিপিন লাগিয়ে দু-বেণী ঝুলিয়ে ছুট্টে স্কুলে যায়। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর পাই ওই মেয়ে এবার মাধ্যমিকে ফার্স্ট। বাড়ির সামনে টিভি ভ্যানে রাস্তা জাম। উঠে বসে চোখ কচলে ভাবি, ভাবতে বসি…
সঙ্গীতার আমোদিনী সেই পাশের বাড়ির মেয়ে। চিনি অথচ কিছুই চিনি না। কিন্তু আমোদিনীর আছে এক জাদু আয়না। ঘামে-ক্লান্তিতে-উদ্বেগে-গ্লানিতে ভরা আমাদের ক্যাংলা পৃথিবীর হ্যাংলা ছবি সেই আরশিতে পড়ে, ও মা কী কাণ্ড, জীবন মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে গেল, দেখ!
চোখ কচলে ভাবতে বসি — এ কেমন বই? সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়ের ‘আমোদিনীর আরশি’। পাশের বাড়ির মেয়ের গল্প বলে ও। আর বলেও খুব নিচু গলায়। দৃষ্টি আকর্ষণ করে কই। আর পাঁচটা মেয়ের মতো এও এক মেয়ে। কিন্তু মেয়ের হাত খুব পরিষ্কার, আরশি কখন ক্যালাইডোস্কোপে বদলে দিয়েছে টের পাই না। ভাঙা চুড়ি (আসলে জীবনের ভাঙা টুকরো টুকরো ঘটনা) কী অলৌকিক বিভ্রমে জুড়ে জুড়ে গিয়ে তৈরি হয় মায়া বিচ্ছুরণের আলপনা — না, না, আলপনা নয়, নক্সি কাঁথার জমি।
গল্পের সব ক-টি চরিত্র কাল্পনিক নয়, সবই পাশের বাড়ির মানুষ, পাশের বাড়ির জীবন। যা আমাদের চোখে পড়তে পড়তেও পড়ে না। তবে কি সবই কি আটপৌরে? আমোদিনীর রং-ঢং নেই? আছে। সে এক সাতরঙা রামধনু। রঙের ভিতরে রঙ তার ভিতরে ময়ূরকণ্ঠী জেল্লা। প্রেমের কত রূপ তার কতই বা চিনি আমরা। ‘খেলাবেলার শেষে’ গল্পে আমোদিনী প্রেমকে রঙ ভরে ক্যালাইডোস্কোপে ফেলে দেখেছে কত আলপনা ফোটাতে পারে প্রেম! বড় নিষ্পৃহে দেখেছে আমোদিনী, যেমন লেখকের স্বভাব আর কী। কিন্তু আমোদিনী তো জীবনের সঙ্গে জীবন হয়ে মিশে আছে, তাই বুকের গোপন মোচড়টুকু পাঠককে ছুঁয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সে বড় অভিজাত উদাসীন। এই গল্প বহুদিন থেকে যেতে এসেছে। ‘আলি আর চাঁদবালি’, ‘স্নেহময়’ গল্পগুলি লেখিকার জাত চিনিয়ে দিয়ে যায়। এসব গল্প আমার শেষবেলায় আনন্দপাঠ। আমার সেই আনন্দপাঠের যাত্রাকাহিনিই এখানে ধরে রাখার চেষ্টা। সঙ্গীতার লেখার প্রতি আমাদের কৌতূহল তৈরি করে দিয়ে গেল আমোদিনী। আমোদিনীকে ভুলতে সময় নেবে।
— অরুণ আইন
Be the first to review “আমোদিনীর আরশি”