টুরা, তৃষা, দেবাং-এর গল্প

180.00

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়ের লেখা গল্প– ছোটোদের গল্প কী করে শোনাতে হয়, তার গল্প।

…সমরেশ বসুর ‘গোগোল’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সন্তু’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাধু কালাচাঁদ’, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ‘তোপ‌সে’ তো বাঙালি পাঠক পিতামাতার— কেবল টার্গেট অডিয়েন্স কিশোরদের নয়— হৃদয়ে অক্ষয়-অব্যয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। কিন্তু ভানু ব্যানার্জির দেশে অনায়াসে ‘স’ বাদ দিয়েও বলা যায় এর পরও ‘দুইখান কথা আছে’। প্রথমটা হল, বাৎসল্য রসকেন্দ্রিক রচনায় উপলক্ষ্য শিশু বা বৎস হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য ‘বৎসল’-রা, অর্থাৎ দাদু-দিদা (উভয়ার্থে), বাবা-মা, জ্যাঠা-জেঠি, কাকা-কাকি, পিসে-পিসি, মামা-মাসি— যাদের একসঙ্গে আঙ্কল বা আন্টি বলা হবে না কেন, এই নিয়ে অধুনা মোর এক আমেরিকা-প্রবাসিনী তরুণী আত্মীয়া আপত্তি করেন। আমার ‘আপইত্ত’ এখানেই— এই সম্বোধনে তাঁরা তো ধরা পড়েনই না, এমনকি বাদ রয়ে যান আগেকার দিনে অনেক বয়সে বড় দাদা-দিদিরাও, যাঁরা এদের আদর দিয়ে বাঁদর করতে করতে চোখে হারাতেন। সেই লেখা কি আজও অনেক লেখা হয়? তবে তত চোখে পড়ে না কেন? আর হলেও তো শৈশব-হারানো, আত্মীয়-পরিজন-বিচ্ছিন্ন, মা-বাবার সদাজাগ্রত সযত্ন প্রহরার ‘প্যানপ্টিসিজম’-এ দুরারোগ্যভাবে আক্রান্ত, টেক-স্যাভি কিশোর-কিশোরীরা, সেখানে খুব বেশি হলে গোয়েন্দাগল্প বা কল্পবিজ্ঞান কাহিনির নায়ক-নায়িকা কিংবা চরিত্র হয়, বা তাদের পড়ে। সিনেমায়, নাটকেও তো একই আকাল, যার কথা এক টিভি চ্যানেলের এক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেই দিলেন। দ্বিতীয় কথাটা হল, এমন অনেক বাৎসল্য রসকেন্দ্রিক রচনা আছে, যেগুলি শিশুরা পুরোপুরি বুঝবে না। পড়ে ভালো লাগলেও সম্পূর্ণ অর্থ বা রসগ্রহণ করতে পারবে না। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ বা ‘গল্পস্বল্প’। সত্যি কথা বলতে হলে, কোনও বাচ্চা কি ‘অ্যালিস ইন দি ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এন্ড ‘থ্রু দি লুকিং-গ্লাস’-এর পূর্ণ অর্থ ও রসগ্রহণ করতে পেরেছে? বিশেষ করে দ্বিতীয়টিতে, যেখানে গোটা কাহিনিক্রিয়াটাই এগোচ্ছে একটি দাবার চালের সমস্যার ভিত্তিতে, যেখানে অ্যালিস এগোচ্ছে দাবার ছক বরাবর এক সাদা ঘুঁটি হিসেবে, যে পরে সাদা কুইনে প্রোমোশন পাবে, আর রেড কিংকে কিস্তিমাত করবে। এমনকি লিউইস ক্যারল নিজেও তো বইটির ১৮৯৬ সালের ভূমিকায় বলে দিয়েছিলেন যে এই কাহিনিতে সাদা আর লালের চালের পালটাপালটি (‘alternation’) হয়তো ততটা কঠোরভাবে মানা হয়নি, যতটা উচিৎ ছিল; আর তিন কুইনের ‘ক্যাসলিং’-এর মাধ্যমে হয়তো কেবল রানিরা প্রাসাদে গেলেন, এই কথাটাই অন্যভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু এ ছাড়া ছয় নম্বর চালে সাদা রাজার ‘কিস্তি’, সাত নম্বর চালে কালো ঘোড়াকে খাওয়া, আর সবশেষে কালো রাজার কিস্তিমাত একেবারেই খেলার নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে। যে কেউ ছক পেতে, ঘুঁটি বসিয়ে খেলে মিলিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এ কি ‘বৎস’দের কাজ? লিউইস ক্যারলের বাৎসল্যরস যতই মনস্তত্ত্বসাপেক্ষ হোক‍ না কেন।
প্রিয় পাঠক, আমার এই ক্ষুদ্র বইতেও লক্ষিত আপনি। আপনার শিশুপুত্র কী কন্যা, কী তাদের স্থানীয়-স্থানীয়ারা অবশ্যই পড়তে পারে এই বই। বই পড়ে কেউ খারাপ হয়েছে তা এই মতদ্বৈধ-দীর্ণ পশ্চিমবঙ্গেও কেউ বলবে না! কিন্তু বাৎসল্য রসে জারিত এই ক্ষুদ্র কাহিনিগুলিতে আমার স্বভাবদোষেই হোক আর অভ্যাসগুণেই হোক, সাহিত্য, দর্শন, (বিশেষত আধুনিক বাংলা) কবিতা, সমকাল ও সমসমাজের যে ছায়াপাত ঘটেছে তা হয়তো শিশুদের পক্ষে একটু ‘রিচ ব্রু’।
এই বইটিতে দুরকমের লেখা আছে। এক তিনটি শিশুকে দেখে, আর তাদের আজব চিন্তাভাবনা দেখে আমার তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়া আর গপ্প বানানো, অথবা ওদেরকে বলা আমার কিছু মৌলিক গল্প। আর শেষ কথা, কাহিনিগুলিতে আমার কিছু পরমাত্মীয়দের স্পষ্ট ছায়া পড়লেও চরিত্রগুলি ঠিক তারা নয়, তাদের ছায়া। তুলনা করা যায় পাড়ার সোনার দোকানের গয়নার সঙ্গে সোনা কম, খাদ বেশি।…

– অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

Customer Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “টুরা, তৃষা, দেবাং-এর গল্প”

Your email address will not be published. Required fields are marked *