এই বইটি সাজাতে সাজাতে বারবার মনে হয়েছে, এ-বইয়ের পাঠক কেবল মেয়েরা নয়। কেননা এ-বইতে আমার দেখাটা মেয়েদের চোখে মেয়ে ও পুরুষ অধ্যুষিত গোটা পৃথিবীকেও দেখা। সেই যবে থেকে ছোট্টবেলায় জেনেছিলাম ‘মেয়েলি’ একটি নিন্দাসূচক বিশেষণ, সেদিন থেকেই মেয়েদের নিজস্ব জগৎ কেন গোটা পৃথিবীর মধ্যে একখানা আলাদা এলাকা হয়ে গেল, তা আমাকে বড্ড ভাবায়। কোথায় যে কী ভুল আছে মেয়েদের আলাদা করে দেখায় আর ভাবায়, সে নিয়ে গুনগুন করে উঠেছে আমার আপত্তি আর অসম্মতির সুর; আর সে সুরে ধুয়ো দিয়েছে নব্বই দশক থেকে ক্রমাগত পড়ে চলা নারীবাদীদের লেখালেখি আর নারীবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের সবদিককে পড়ার চেষ্টা… সেই থেকে তৈরি হয়ে উঠেছে এই বই।
তা বইয়ের নাম ‘খণ্ডিতার বিশ্বদর্শন’ কেন দিলাম? নাহোক বহোত খটোমটো নামকরণ, তাই না? আসলে, বিশ্বদর্শন বলে মেয়েদের আদৌ কিছু হয় কিনা, সেটাই তো একটা প্রশ্ন। সেই কবে জার্মেন গ্রিয়ারের দ্য ফিমেল ইউনাখ পড়তে পড়তে শুনে ফেলেছিলাম, নারীবাদের ওই চাবি-বই নাকি ভীষণ একপেশে। আপত্তির সুরে বলেছিল কোনও কোনও ছেলেবন্ধু, মেয়েবন্ধুও ছিল এক আধজন। তা সেই একপেশে নারীবাদকে ভালোবেসে, তার হয়ে সওয়াল করে করে এতদিন কেটে তো গেল। নারীর দর্শন, নারীর দেখা, নারীর চোখ… দৃষ্টিকোণ, তার একপেশেমি আজও আমাকে ছেড়ে গেল না। তাই খণ্ডিত সেই বিশ্বদর্শনকেই এখানে রেখেছি বিছিয়ে… সাজিয়ে দিয়েছি পাঠকের পাতে আমার অন্নব্যঞ্জন, যার নুনটা পর্যন্ত নারীদৃষ্টির অন্তর্গত। সেই বিশ্বদর্শন যদি খণ্ডিতই হয়ে থাকে, একপেশেই হয়ে থাকে, তা তো বস্তুত এক খণ্ডিতারই দর্শন, তা-ই খণ্ডিত। এযাবৎ মেয়েদের জগতকে পুরুষের জগতের মতো বিশাল করে কেউ কি দেখিয়েছে? কেউ কি বলেছে, মহাবিশ্বে মানব একাকী ভ্রমিয়া বেড়াবে যেমন, মানবীও বেড়াবে? কেউ কি বলেছে, হিস স্টোরি যদি হিস্টরি হয়, তবে সে ইতিহাসে হার স্টোরিও বলা হবে! তাই মেয়েরা জন্মইস্তক খণ্ডিতার জীবনযাপন করে। খণ্ডিতা, মনে করিয়ে দিই, বৈষ্ণব সাহিত্যে দয়িতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নারীরই অভিধা। কিন্তু কীর্তনের আখরে আখরে প্রেমিকবিরহিতা খণ্ডিতা, সচরাচর বৈষ্ণব কাব্যে কৃষ্ণবিচ্ছেদে বিষাদঘন রাধিকা… তা-ই কি একমাত্র খণ্ডিতার উদাহরণ? বাকি সব, সব মেয়েরা, যারা জন্ম থেকে সব ব্যাপারে বিরহিত, বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছে, জীবনের সবরকমের স্বাদ রং থেকে, স্বাধীনতা থেকে, ভ্রমণ-রমণ-কর্ম-আনন্দ কোথাও যার সরাসরি অধিকার নেই, সেও কি আসলে খণ্ডিতা নয়? যাকে একটা চাপা কুয়োর মতো মেয়ে-ইমেজের ভেতর আটকে রাখা হয়েছে, যে শুধু সাজবে, মিষ্টি করে হাসবে, বোকা হয়ে থাকবে, অবোধের মত আধো-আধো কথা বলবে, সে-ও কি খণ্ডিতা নয়?
সেই সব খণ্ডিতাদের খণ্ডিত বিশ্বদর্শনের কথা… এই বইতে সাজিয়ে দিলাম। লেখাগুলি গত দশ বা পনেরো বছরের লেখা মূলত। অল্প এক দুটি লেখা অবশ্য আছে ১৯৯০ দশকের, প্রথম প্রথম নারী-অস্তিত্বের ভেতরদিক থেকেই, সমাজের নানা বিস্ময়কর বৈষম্য দেখার চোখে লেখা। সেই বিস্ময়ের ধার আজ কমে গেছে। তবু আজও চমকে উঠি নতুন কোনও আগ্রাসনে, আক্রমণে। এই ধারাবাহিক দেখারই নমুনা রইল এখানে। রইল গল্পকবিতায়, সিনেমায়, সিনেমার গানে, মানে মোটের ওপর সাহিত্য-শিল্পে মেয়েদের কীভাবে দেখা ও দেখানো হয় তার খতিয়ান, ‘নারীর চিত্রায়ণ’ অংশে। আবার ‘নারীর বাস্তবতা’ অংশে রইল মেয়েদের এক-একটা দিকের অবস্থা ও অবস্থানের কথা, কিন্তু নিজের অজান্তেই হয়তো সেখানেও শিল্প সাহিত্যের চিত্রায়ণ ঢুকে গেল। একেবারে জলনিরোধক খোপে ঢোকানো যাবে না এইসব মেয়েবিষয়ক কথা। তবু ‘নারী আর সম্পর্ক’ অংশে নিজের শরীরের সঙ্গে নিজের সম্পর্কও রইল, রইল বিবাহ, পিরিয়ড, মাতৃত্বের কথা। যেমন রইল আশ্চর্য সে যুগের কিছু আত্মীয়াদের কথাও। ‘নারীশরীর আর হিংসা’ পর্বে ধর্ষণ, অ্যাসিড আক্রমণ, শিশুদের বা বৃদ্ধাদের মলেস্টেশন নিয়ে কথা রইল। ‘মি টু’ আন্দোলনের কথা, কর্মরতা জীবনের অভিজ্ঞতা, তাও রয়েছে এখানে।
যশোধরা রায়চৌধুরী
Be the first to review “খণ্ডিতার বিশ্বদর্শন”